নিউজনেস্ট

হাতেম তাই: দান ও দরদের কিংবদন্তি

হাতেম তাই: দান ও দরদের কিংবদন্তি
হাতেম তাই: দান ও দরদের কিংবদন্তি। ছবি: প্রতীকি

হাতেম তাই। ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্ব। দান ও উদারতার কথা শুনলেই যার কথা হৃদয়ে ভেসে উঠে। প্রাচীন আরবের এই মহান ব্যক্তি কেবল তার ধন-সম্পদ নয়, মন ও মননের উদারতার জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। তার উদারতার গল্পগুলো আজও মানুষের মধ্যে প্রেরণা যোগায়। একজন চিরন্তন মানবতার প্রতীক হিসেবে তার উদারতা, দানশীলতা এবং নৈতিক গুণাবলী কেবল জাহেলি যুগেই নয়, ইসলাম আসার পরও সন্মানিত ও স্বীকৃত হয়েছিল। ফলস্বরূপ একটি মহান চরিত্র হিসেবে ইতিহাসে আজও তিনি সমাদৃত।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

ইতিহাসখ্যাত হাতেম তাইয়ের জন্ম জাহেলি যুগে। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের আগে। যদিও তার সঠিক জন্ম সাল জানা যায় না । হাতেম তার মা ‘আতবা বিনতে আফিফ’ এর তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছিলেন। তার মা ছিলেন একজন সম্পদশালী নারী। হাতেম তার অসামান্য উদারতা উত্তরাধিকার সূত্রে নিজ মার থেকেই পেয়েছিলেন। তার মা যেমন কারো আবদার ফিরিয়ে দিতেন না, তেমনই হাতেমও তার মায়ের মতোই কখনও সম্পদ জমা রাখতেন না এবং কারো সাহায্যের আহ্বান উপেক্ষা করতেন না। তিনি তার পরিবারের সম্পদকে কখনোই শুধুমাত্র নিজের জন্য ব্যবহার করেননি, বরং তা সবসময় দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন।

বিবাহ ও সন্তান

হাতেম তাই দুটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন নুয়ার এবং দ্বিতীয় স্ত্রী মাওইয়া বিনতে আফজার। দ্বিতীয়জন থেকেই বিখ্যাত সাহাবি আদী ইবনে হাতেম রাজিআল্লাহু আনহু জন্ম গ্রহণ করেন। কোন কোন ইতিহাসবিদের মত অনুযায়ী, হাতেমের মাওইয়া থেকে কেবল আদি নামে একটি পুত্রসন্তান ছিল। তবে অন্যান্যদের মতে, হাতেমের প্রথম স্ত্রী নুয়ার থেকে তার তিন সন্তান ছিল- আদি, আবদুল্লাহ এবং সাফফানা।

দানের কারণে তালাক

কয়েক বছর সংসার করার পর হাতেমের দ্বিতীয় স্ত্রী মাওইয়া হাতেমকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি হাতেমের অতিরিক্ত উদারতা এবং তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। তার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তিনি হাতেমকে তার এই স্বভাব থেকে বিমুখ করতে ব্যর্থ হন। মাওইয়া তার চাচাতো ভাই মালিকের উসকানিতে হাতেমকে তালাক দেন। মালিক তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তালাকের পর তিনি মাওইয়াকে বিয়ে করবেন এবং তার ও তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখবেন।

উদারতা ও মানবপ্রেম

হাতেম তাইয়ের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তার অনুপম উদারতা। লোককথায় প্রচলিত আছে, কোনো দরিদ্র ব্যক্তি যদি তার কাছে সাহায্য চাইত, তিনি কখনোই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। এমনকি একবার তার কাছে কোন কিছু না থাকায়, নিজের ঘরের ছাদ ভেঙে সেটি বিক্রি করে একজন ভিক্ষুককে সাহায্য করেছিলেন। এই ঘটনা তার নিঃস্বার্থ পরোপকারের সফেদ প্রতীক।

হাতেমের মানবপ্রেম শুধু তার গোত্র বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তার দানের হাত ছিল সর্বজনীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘সত্যিকার মানুষ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে অন্যের কল্যাণে নিজের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।’

হাতেমের একটি উদারতার গল্প

হাতেমের স্ত্রী মাউইয়া একবার তার স্বামীর উদারতা সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। কোন এক দুর্ভিক্ষের সময়, যখন খাবারের প্রচন্ড অভাব ছিল, হাতেমের আপন সন্তানরা ক্ষুধায় কাঁদছিল। তখন তাদের প্রতিবেশী এক মহিলা তার ক্ষুধার্ত সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। হাতেম তখন তার স্ত্রীকে বলেছিলেন সে মহিলার সন্তানদের তার কাছে নিয়ে আসতে। তার স্ত্রী তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাদের নিজেদের সন্তানেরা ক্ষুধায় কাঁদছে এবং খাওয়ার জন্য কিছু নেই। কিন্তু হাতেম তাকে শান্ত থাকার জন্য বলেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তিনি সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করবেন।

এরপর তিনি তার নিজের ঘোড়াটিকে জবাই করে রান্না করেন এবং মহিলাকে ও তার সন্তানদের খাওয়ান। তিনি নিজের পরিবারকেও খাওয়ান এবং আশেপাশের সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। তাদের সবাইকে খাওয়ানোর পর হাতেম নিজে কিছু না খেয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে শুয়ে ছিলেন।

উপসংহার

হাতেম তাইয়ের জীবন ছিল মানবতা, দানশীলতা এবং উদারতায় ভরা। তার উদারতা কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং মানুষের মনে আজও প্রেরণা যোগায়। তার জীবন আমাদের স্পষ্টভাবে শেখায় যে, প্রকৃত মানুষের মূল্য কেবল তার অর্জনে নয়, বরং সে কতটা নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের সাহায্য করতে পারে তার ওপর নির্ভর করে।

আতাউল্লাহ আয়মান
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত