ইতিহাসের পাতায় অনেক আলো ঝলমলে মনীষীর নাম আছে, যারা নিজেদের অসাধারণ মেধা ও জ্ঞানের মাধ্যমে মানবকল্যাণে অসংখ্য অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে সিনা এমন একজন, যিনি চিকিৎসা বিদ্যা, দর্শন, বিজ্ঞান এবং গণিতের মতো শাস্ত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন। মধ্যযুগের প্রাচীন ইসলামি সভ্যতায় তাঁর যে অবদান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
জীবন ও শৈশব
আবু আলী হুসেইন ইবনে সিনা- সংক্ষেপে ইবনে সিনা- ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আফশানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুল্লাহ বালখ শহরের বাসিন্দা ছিলেন। মা সিতারা ছিলেন তাজিক শহরের। ছোটবেলায়ই ইবনে সিনার বুদ্ধিমত্তা ও অধ্যবসায় দেখে তার পরিবার তাকে সর্বোত্তম শিক্ষার সুযোগ দেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন এবং ভাষা, সাহিত্য, ইসলামি আইনশাস্ত্র, দর্শন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর অভূতপূর্ব দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল বিস্তৃত ও গভীর। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি একজন নামকরা চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
চিকিৎসাবিদ্যায় অবদান
ইবনে সিনার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো তার মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়া ‘আল কানুন ফিত তিব’ (The canon of Medicine)। পাঁচ খণ্ডের এই গ্রন্থটিতে মানবদেহের রোগ এবং তার নিরাময়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র ইসলামি সভ্যতায় নয়, ইউরোপের চিকিৎসাবিদ্যায়ও বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর বইগুলো চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও ইবনে সিনা সংক্রামক রোগের কারণ ও প্রতিকারের ধারণা দেন। নারীদের রোগ এবং মানসিক রোগের উপর গবেষণা করেন। অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যার নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রও আবিষ্কার করেন ইবনে সিনা।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান
চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি ইবনে সিনা দর্শন, গণিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তার দর্শনমূলক কাজ ’কিতাবুশ শিফ‘ (The Book of Healin) চার ভাগে বিভক্ত: যুক্তি, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত এবং অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স। তিনি প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের যুক্তি ও দর্শন নিয়ে কাজ করেছেন এবং তাঁদের চিন্তাভাবনাকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এছাড়াও তিনি পদার্থবিদ্যায় আলোর গতি এবং শব্দের তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেন এবং জ্যোতির্বিদ্যায় নতুন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। যেমন, ‘শুক্রগ্রহ সূর্যের কাছাকাছি’।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা ইরানের হামাদান শহরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ দাস ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দান করে যান। জ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখায় রাখা তাঁর অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এবং তাঁর লিখিত বই ও গবেষণা আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসাশাস্ত্র ও দর্শনের জগতে আলো ছড়াচ্ছে।
ইবনে সিনার জীবন-কর্ম এবং আবিষ্কারগুলো শুধু ইসলামী সভ্যতারই গর্ব নয়, এগুলো সমগ্র মানবজাতির জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। তার জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়, জ্ঞান ও বিজ্ঞান কখনোই কোন সীমা মানে না। এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে তা পুরো পৃথিবীর কল্যাণে কাজে আসতে পারে।
তথ্যসূত্র: আরবি ওয়েবসাইট আলমাউজু থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত