নিউজনেস্ট

রাসুল মুহাম্মাদ সা.: যে আলোয় আজও আলোকিত বসুন্ধরা

রাসুল মুহাম্মাদ (সা.): যে আলোয় আজও আলোকিত বসুন্ধরা
মসজিদে নববি। ছবি: নিউজনেস্ট

চলছে রবিউল আওয়াল মাস। এ মাস নবীজির আগমন এবং তাঁর ওফাতের  মাস। এ মাসকে ঘিরে মুসলমানদের হৃদয়ে জেগে ওঠে গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধার অনুভূতি। চতুর্দিকে নামে খুশির ঢল। পুরো পৃথিবী আনন্দোৎসবে মেতে ওঠে এ দিনটিকে কেন্দ্র করে। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই নয়, বরং এ দিনটিতেই মানবজাতির জন্য খুলে গিয়েছিল রুদ্ধ আলোর দুয়ার। যে আলো দিয়ে মুহাম্মাদ নামের এক মহামানব মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ডেকে এনেছেন, সত্যের সন্ধান দিয়েছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

তাঁর চরিত্রের মহিমা এতই বিশাল যে, প্রতিটি মানুষ প্রতিটি যুগেই তাঁকে অনুসরণ করতে চায়। কারণ তিনি শুধু একজন ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। যিনি সত্যিকার মানবতার শাশ্বত পথ দেখিয়েছেন। তাঁর কথা, তাঁর কাজ, তাঁর নীতি- সব কিছুতেই রয়েছে প্রজ্ঞা, মমত্ববোধ, সহানুভূতি, দয়া এবং ন্যায়বিচারের চিরন্তন শিক্ষা।

তাই প্রতিটি রবিউল আওয়াল মাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন আমাদের জন্য চিরন্তন শিক্ষার আধার। স্বাভাবিকভাবেই নবি মুহাম্মাদ, রাসুল মুহাম্মাদ এক অদম্য চরিত্র। রাসূলের চরিত্রের গভীরতা বুঝতে যা ধারণ করার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মুসলিমের।

যদিও রাসূলের ছোট্ট একটি জীবনকে ঘিরে লেখা হয়েছে অসংখ্য বই-পুস্তক। কিন্তু বর্তমানে মানুষ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে ক্রমাগত সংক্ষিপ্ততার দিকে ছুটছে। মানুষের পক্ষে এখন দীর্ঘ বই পড়ার সময় হয়ে উঠে না।

তাই এখানে সংক্ষিপ্ত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের রূপরেখা টানা হলো

নবীজির জন্ম ও শৈশব

  • হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন, যাকে ইসলামিক ক্যালেন্ডারে “আমুল ফিল” বা হাতির ঘটনার বছর বলা হয়।
  • তাঁর জন্মের পর তাঁর মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন, তাঁর গর্ভ থেকে এক আলো বেরিয়ে এসে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত করছে।
  • জন্মেরপূর্বেই তিনি পিতা হারিয়ে এতিম হয়ে যান। জন্মের পর মায়ের কোল ছেড়ে দুধমা হালিমা সাদিয়ার কাছে কিছুদিন লালিতপালিত হন। এরপর ছয় বছর বয়সে মাতা আমিনাকে হারিয়ে মাতৃস্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন। পরবর্তীতে দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিব তাকে লালন-পালন করেন।

 

মুহাম্মদ সা. এর যৌবনকাল

  • নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যৌবন অবস্থায় তৎকালীন মক্কায় “আল-আমিন” (বিশ্বাসযোগ্য) ও “আস-সাদিক” (সত্যবাদী) নামে পরিচিত ছিলেন।
  • এরপর মক্কার চল্লিশোর্ধ্ব ধনী মহিলা খাদিজা রাজিআল্লাহু আনহু এর সাথে ২৫ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

হেরা গুহায় ধ্যান ও প্রথম ওয়াহি

৪০ বছর বয়সে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার নিকটবর্তী হেরা গুহায় ধ্যান করা শুরু করেন। এ সময়ে এক রাতে ওয়াহিবাহক জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে প্রথম ওয়াহি নিয়ে আসেন। সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত এ সময়ই  নাজিল হয়। কোরআনের সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত ছিল “ইকরা”(পড়)। এর থেকে ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন হয়।

গোপন ও প্রকাশ্যে দাওয়াত

  • ওহি লাভের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে গোপনে ইসলামের দাওয়াত শুরু করেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে তিন বছর পর তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন।
  • মক্কার মানুষ প্রথমে তাঁর প্রতি আস্থা রাখলেও পরে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের পৈশাচিক অত্যাচার শুরু করে।

মক্কায় অত্যাচারের তীব্রতা এবং হাবশায় হিজরত

ইসলামের দাওয়াতের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর অনুসারীদের উপর কুরাইশরা প্রতিনিয়ত চালাতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। দিনদিন যা  আরও বৃদ্ধি পয়। ফলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু সাহাবাকে হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করতে বলেন। পরে হাবশার রাজা নাজাশি মুসলিমদেরকে সুরক্ষা প্রদান করেন।

তায়েফে দাওয়াত ও প্রতিকূল সময়

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে দাওয়াতের জন্য যান। কিন্তু তায়েফের লোকেরা তাঁকে গ্রহণ করেনি। শোনেনি কোন কথা। বরং তাঁকে প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত করে দেয়। যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পা ও পাদুকা মোবারক রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। যা আজ অবধি মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে।

রাসূল সা. এর মেরাজ

নবুওয়াতের দশম বছরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাত্রে আল্লাহর দর্শন লাভে উদ্দেশ্যে প্রথমে মক্কার বাইতুল্লাহ থেকে আলআকসা মসজিদে যান এবং বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বোরাকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দ্রুতগামী এক বাহন) সোয়ার হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে রওয়ানা করেন। সেখানে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। একই রাতে তিনি জান্নাত জাহান্নাম ঘুরে ঘুরে দেখে আসেন। মুসলিমদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান সে রাতেই ফরজ করা হয়। বিশেষ এই ঘটনাকে সিরাতের পাতায় ‘মিরাজ’ বলা হয়।

মদিনায় হিজরত ও সাহাবিদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন

মক্কার মুশরিকদের অসহ্য অত্যাচার ও আল্লাহর নির্দেশে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় পৌঁছে তিনি প্রথমে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। “মসজিদে নববী” নামে যা সকলের কাছে পরিচিত। পাশাপাশি তিনি মুসলিমদের মাঝে ঐক্য স্থাপনের জন্য মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার।

রাসূলের যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়

  • রাসুলের মদিনায় হিজরত করার পরও মক্কার কুরাইশদের মুসলিমদের নিয়ে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ফলে ২য় হিজরির বদর যুদ্ধ থেকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবা এবং বিধর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উহুদ, খন্দক, খায়বার, বনু নজির, বনু কুরায়জা, মক্কা বিজয়, তাবুক ইত্যাদি। তিনি পুরো জীবনে ২৭টি যুদ্ধে সশরীরে অংশগ্রহণ করেন ও ৪৭টি ঝটিকা বাহিনী প্রেরণ করেন।
  • ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে রাসূলের জন্মভূমি মক্কায় ইসলামের বিজয় সূচিত হয় এবং যুদ্ধ শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে ক্ষমা করে দেন।

বিদায় হজ এবং চির বিদায়

  • ১০ম হিজরিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একমাত্র হজ সম্পাদন করেন, যা ইসলামে ‘বিদায় হজ’ নামে পরিচিত। সেই হজে তিনি এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খুতবা প্রদান করেন, ইতিহাসে যাকে ‘বিদায় ভাষণ’ নামে স্মরণ করা হয়।
  • এর পরবর্তী বছর মাত্র ৬৩ বছর বয়সে, ১১ হিজরির ১২ই রবিউল আউয়ালে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরকালের পথে যাত্রা করেন।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই চমকপ্রদ জীবন মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার উৎস। যা ধৈর্য, ন্যায়বিচার, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করার শিক্ষা দেয়।

শাহাদাত হুসাইন
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত