দাসপ্রথা মানবেতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। হাজার বছরের পুরনো যার শেকড়। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত দাসদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। হাটে বাজারে পণ্য হিসেবে সে যুগে দাসরূপে বিকোত মানুষ। গ্রিস, রোমান, মিশর, পারস্য এবং আরব অঞ্চলে দাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে সামাজিক মর্যাদা বলতে দাসদের কিছুই ছিল না। তারা হতো মনিবদের সম্পত্তির অংশ। তাদের জীবন ছিল অত্যাচার শোষণ ও নিপীড়নের এক ঘুর্ণায়মান চক্র।
প্রাক-ইসলামি যুগে দাসপ্রথা
প্রাক-ইসলামি যুগে যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসেবে দাসদের ব্যবহার করা হতো। যুদ্ধবন্দীদের বিক্রি করে অথবা বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসেবে মানুষদের দাসরূপে বিক্রি করে দেয়া হতো। তৎকালীন আরব অঞ্চলে দাসপ্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত থাকলেও দাসদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না । তারা মানবিক অধিকারের বাইরে মনিবের সম্পত্তিরূপে বিবেচিত হতো। দাসদের কোনো নিজস্ব স্বাধীনতা ছিল না। স্বাভাবিক ব্যক্তি জীবন, সম্পত্তি বা অন্য সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতো তারা। এবং এমন নির্যাতিতরূপেই দাসরা মানব সভ্যতার একটি অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল।
ইসলাম আগমন পরবর্তী যুগে দাসপ্রথা
পাপ-পঙ্কিল এ ধরায় ইসলামের শুভাগমন দাসপ্রথার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ইসলাম দাসপ্রথা একবারেই বিলোপ না করলেও, দাসদের প্রতি মানবিক ও ন্যায়বিচারমূলক আচরণের অনন্য নজির স্থাপন করে। হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিমূলক আচরণ করতে উৎসাহিত করেন। দাসদের অধিকার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দাসকে মুক্ত করবে, আল্লাহ তা’আলা তার প্রত্যেক অঙ্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন।’
ইসলামে দাসের প্রতি ভালো ব্যবহার এবং তাদের মুক্ত করার প্রতি অনেক উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের এমন উপদেশে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই তাঁদের অধীনস্থ বহু দাসদের মুক্ত করে দেন। যেমন, হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বহু দাস ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
দাসমুক্তি বা গোলাম আজাদ করা মুসলমানদের পাপমুক্তির মাধ্যম ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাফ্ফারা (পাপমোচন) হিসেবে দাস মুক্ত করার নিয়মও ইসলামে রয়েছে। যেমন, ভুলবশত হত্যার কাফ্ফারা হিসেবে একজন দাস মুক্ত করার বিধান।
দাসমুক্তিতে ইসলামি শরিয়ার অভিনব পদ্ধতি
ইসলামি শরিয়ায় (আইনে) দাস-দাসীদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন অভিনব পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দাসমুক্তির জন্য উৎসাহ প্রদান। যেমন, দাসমুক্তির পুরস্কার হিসেবে জান্নাতপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি, কাফ্ফারা হিসেবে দাসমুক্তি এবং মনিবের অত্যাচারের কারণে দাস মুক্ত করার বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি। এছাড়া ইসলাম যুদ্ধবন্দীদের দাস করার পরিবর্তে মুক্তিপণ গ্রহণের সুযোগও রেখে দিয়েছে।
একইসাথে ইসলামে দাস-দাসীদের সাথে ভালো আচরণ করার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। দাসদের প্রতি শোষণমূলক আচরণ, বিশেষত শারীরিক নির্যাতন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘যদি কোনো মনিব তার দাসকে অত্যাচার করে, তবে আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন।’
দাস-দাসীদের মুক্তির জন্য ইসলাম অনেকগুলো পন্থা নির্ধারণ করেছিল। যেমন, ‘অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি’। ইসলামি আইনি পরিভাষায় যাকে ‘মুকাতাবা’ বলা হয়। যেখানে দাস ও মনিবের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি হয়, যে চুক্তির ভিত্তিতে দাস স্বীয় মনিবকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে মুক্তি পাবে। এছাড়াও দাসীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হলে সে দাসীও দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া ইসলামের বিধান।
সুতরাং এটা বললে অত্যুক্তি হবে না, ইসলাম সরাসরি দাসপ্রথা বিলোপের নির্দেশ না দিলেও এটিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। ইসলামের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দাসদের মুক্তি, স্বাধীনতা এবং সমঅধিকার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানুষকে উৎসাহিত করেছে দাসমুক্তির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে।
মোটকথা, দাসপ্রথা একসময় মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু ইসলামের আগমনের পর দাসদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে শুরু করে। ইসলামের নীতিমালায় দাস-দাসী মুক্তির জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা সেই যুগের জন্য এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছিল। দাসদাসীকে সামাজিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম মানবজাতির জন্য শান্তি ও মানবিকতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
দাসপ্রথার বর্তমান চিত্র
দাসপ্রথা প্রথমবারের মতো ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রিটিশ সংসদ সে বছর একটি আইন পাস করে, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে দাস বাণিজ্যকে বেআইনি ঘোষণা করে। পরে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পুরোপুরি দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়। এভাবেই অল্প সময়ের ব্যবধানে দাসপ্রথা পুরো বিশ্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও দাসপ্রথা এখন অতীত ইতিহাস, কিন্তু আজও মানবসমাজ সত্যিকার দাসত্বের শেকল ভেঙে চির স্বাধীন হতে পারেনি। বিভিন্নরূপে শোষণ ও নির্যাতনের চিত্র এখনও সমাজে বিদ্যমান। শিশুশ্রম, মানব পাচার, জোরপূর্বক শ্রমের মতো শোষণমূলক কর্মকাণ্ড এখনও সমাজে বহুল প্রচলিত। তাই ইসলামের শিক্ষা এখনও প্রাসঙ্গিক। আজকের সমাজে শান্তি ও মানবতার প্রতিফলন ঘটাতে ইসলামি নীতিমালার বেশ চর্চা প্রয়োজন।
সূত্র: বিভিন্ন অ্যারাবিক সাইট থেকে নেওয়া
শাহাদাত হুসাইন
- শাহাদাত হুসাইন#molongui-disabled-link
- শাহাদাত হুসাইন#molongui-disabled-link
- শাহাদাত হুসাইন#molongui-disabled-link
- শাহাদাত হুসাইন#molongui-disabled-link