বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে, মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমশ গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো যেমন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষ, মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য এবং হিংস্রতা একটি সাধারণ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকদের নীতি, গণমাধ্যমের বক্তব্য থেকে শুরু করে মুসলিমদের জীবনের প্রতিটি স্তরে এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছে।
পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিম বিদ্বেষের সূচনা, এর কারণ এবং সমাজে তার প্রভাব কেমন? বিশ্বব্যাপী এমন বিদ্বেষ কীভাবে ছড়ানো হচ্ছে? কেন মুসলিমরা ক্রমাগত আপন সমাজে বিচ্ছিন্ন ও অনিরাপদ বোধ করছে? গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নগুলোর সমাধান নিম্নে তুলে ধরা হলো।
আমেরিকায় বিদ্বেষের উত্থান
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম “মিডল ইস্ট আই” জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষ। ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রতি সাধারণ সমাজের পক্ষপাতিত্ব অন্য সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক কম। প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হন সেখানকার মুসলিমরা। তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবন ভাবনায় যা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের সামাজিক অবস্থানকে ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে এবং তাদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ব্রিটেনে নিরাপত্তাহীনতা
যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হলেও বিদ্বেষের তীব্রতা এখানেও কম নয়। সম্প্রতি ব্রিটেনে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পর এক জরিপে দেখা গেছে ৯২% মুসলিমই মনে করছেন যে, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দিন দিন তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন। ব্রিটেনে মুসলিমদের এমন আতঙ্ক সমাজে তাদের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণকে কমিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
ইসলামবিদ্বেষের নিম্নমুখী পরিবর্তন
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, কয়েক বছর উন্নতির পর মুসলিমদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। দুই বছর আগে ৭৮% লোক মুসলিমদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও বর্তমানে তা কমে ৬৪% এ নেমে এসেছে। এই হ্রাস ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। মুসলিমদের প্রতি এই নেতিবাচক পরিবর্তন মূলত সমাজে বিদ্যমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজনের প্রতিফলন।
মুসলিম বিদ্বেষের নেপথ্য কারণ
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট ইসলামবিদ্বেষের পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘প্রজন্মের মধ্যে পরিবর্তন, ইহুদি এবং ইসলামের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক, বর্ণবাদ এবং উচ্চশিক্ষার ঘাটতি। নতুন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষের মাত্রা আরও গভীরভাবে শিকড় গেঁড়েছে। যা মূলত ভুল তথ্য এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাবের ফল। পশ্চিমা সমাজে ইসলাম এবং মুসলিমদের সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিদ্বেষের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে।
দ্বৈত মানদণ্ড
ইসলামবিদ্বেষের আরেকটি বড় কারণ হলো, পশ্চিমা রাজনীতির দ্বৈত নীতি। উদাহরণস্বরূপ, ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটি (ডিএনসি) তাদের সম্মেলনের প্রধান মঞ্চে একজন ফিলিস্তিনি বক্তাকে বক্তব্য প্রদানের অনুমতি দেয়নি। কিন্তু একই সময়ে তারা একজন ইসরায়েলি বন্দীর পরিবারের সদস্যদের কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। এই ধরনের দ্বৈত নীতি মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ এবং বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের অবহেলা
মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ বৃদ্ধির আরো একটি বড় কারণ হলো, মুসলিম সম্প্রদায়ের অবহেলা। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দাঙ্গার পর, প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ মুসলিম কাউন্সিলের ফোনকল উপেক্ষা করেন। অথচ এই কাউন্সিলটি যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম মুসলিম সংগঠন। যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের কোনো সাড়া দেননি বা আশ্বস্ত করেননি। এই ধরনের অবহেলা মুসলিমদের মনে আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতা এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করছে।
পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ দ্রুত হারে বৃদ্ধি একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বিদ্বেষের প্রভাব পড়ছে- ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সবক্ষেত্রেই। মুসলিমরা ক্রমেই নিজেদের নিরাপত্তাহীন, বিচ্ছিন্ন এবং অধিকারহীন মনে করছেন। তাই এখন থেকে মুলিমবিদ্বেষের পেছনের কারণগুলো নির্ণয় করে এবং তা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যাতে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য এবং বিদ্বেষের অবসান ঘটে এবং তারা নিজেদের সমাজে নিরাপদ ও সম্মানিত বোধ করতে পারেন।