নাম ও পরিচয়
লিসানুদ্দিন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ সালমানি। ২৬শে রজব, ৬৭২ মতান্তরে ৭১৩ হিজরিতে গ্রানাডা শহরের লোজা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টীয় দিনপঞ্জি হিসেবে তারিখটি ছিল ১৬ই নভেম্বর, ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দ। ক্ষণজন্মা মনীষী লিসানুদ্দিন খতিব একাধারে ছিলেন মন্ত্রী, ইসলামি ফিকহবিদ, বিজ্ঞ সাহিত্যিক, কবি, দার্শনিক, চিকিৎসক, ইতিহাসবিদ এবং তৎকালীন আন্দালুসের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬খ্রি.) এর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
শিক্ষা ও বাসস্থান
আরব বংশোদ্ভূত লিসানুদ্দিন এর পরিবার আরব থেকে হিজরত করে আন্দালুসে আবাস গড়ে তুলেন। প্রথমে তাঁর পরিবার গ্রানাডায় বসবাস করলেও, পরবর্তীতে স্পেনের টলেডো শহরে চলে যায়। শিক্ষা ও সাহিত্যের জন্য তাঁর পরিবারের পূর্ব পরিচিতি ছিল। লিসানুদ্দিন গ্রানাডার ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেন। তাতে তাঁর পিতার জ্ঞান ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে আলোকপাত করেন।
লিসানুদ্দিন বেড়ে উঠেন গ্রানাডায় । উল্লেখ্য, গ্রানাডা ছিল তখন আলেম-উলামা ও সাহিত্যিকদের কেন্দ্রস্থল। তাই লিসানুদ্দীন সহজেই বিজ্ঞ পন্ডিতদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষালাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন।
রাষ্ট্রিয় কাজে লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব
লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব তাঁর সময়কার শাসক সুলতান গনি বিল্লাহ এর আস্থা অর্জন করলে সুলতান তাঁর উপর দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ফলে তিনি ‘জুল ওয়াজারাতাইন’ বা ‘দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল’ উপাধি লাভ করেন।
লেখালেখিতে লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব
লেখালেখির জগতে লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মহান এই ব্যক্তি রাষ্ট্রিয় দায়িত্বে উঁচু পদের শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও লেখালেখির কাজ চালিয়ে গেছেন অনবরত। রাষ্ট্রের কাজে দিনে লিখতে না পারলেও রাতে লিখতেন তিনি। তাঁর লিখিত কাব্যের মধ্যে থাকত দর্শন, কবিতা, ইতিহাস, ভূগোল, আইনশাস্ত্র, ঔষধিবিদ্যার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী। প্রসিদ্ধ কবি হওয়ায় তাঁর কবিতায় আল হামরা প্রাসাদের দেয়াল আজও রয়েছে সুসজ্জিত।
১৭ শতকের ইতিহাসবিদ আল মাক্কারি (কায়রো, ১৫৭৮-১৬৩২খ্রি.) এর মতে, ইবনুল খতিব রাহিমাহুল্লাহ ইউসুফ (প্রথম) এবং মুহাম্মদ (পঞ্চম) এর শাসনামলে বনু নসরের সময়কালে ৭০ খন্ডেরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এমনও বলা হয়, তাঁর সংকলিত গ্রন্থ ৬০ মতান্তরে ১০০ পর্যন্তও পৌঁছতে পারে। কিন্তু সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয় ছাড়া তাঁর অন্য কোন বিষয়ের গ্রন্থ এখন আর পাওয়া যায় না। তার সংকলিত অধিকাংশ গ্রন্থই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিবের শাহাদাত
১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৭৬০ হিজরির রমজান মাসে গ্রানাডায় একটি অভ্যূত্থান ঘটে। অভ্যূত্থানে সুলতান গনি বিল্লাহ তাঁর রাজত্ব হারান। লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব সুলতান গনি বিল্লাহর ঘনিষ্ট হওয়ায় তখন গ্রানাডা ছেড়ে মরক্কো চলে যান। দীর্ঘদিন মরক্কো থাকার পর তিনি আবার ফিরে আসেন আন্দালুসে। ফিরে এসে নিজ দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ে তাঁকে পুনর্বহালের দাবী জানান। কিন্তু ইবনুল খতিবের দ্বিতীয়বার আন্দালুস আগমন পূর্বের মতন সুখকর হয়নি।
আন্দালুসে আসার বেশ কিছুদিন পরে তৎকালীন সুলতান ইবনুল আহমার তাকে জান্দাকা বা ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গ্রেফতার করে। সুলতান আলেম-উলামাদের একত্র করে তার বিরুদ্ধে ফায়সালা দিতে বলেন। অবশেষে তারা লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিবের ব্যাপারে ফাঁসির ফায়সালা দেয়। এবং ফায়সালা যেদিন হয়েছিল সে রাতেই তাঁর মৃত্যুদন্ডের আদেশ কার্যকর করা হয়।
ইবনুল খতিবের শাহাদাতের পর তাঁর মরদেহের সাথে করা হয় এক ন্যাক্কারজনক আচরণ। মরক্কোর উত্তরাঞ্চলীয় ফেজ শহরের বাব মাহরুকে ইবনুল খতিবকে তাঁর শত্রুরা হত্যা করে দাফন করার পর পুনরায় তার লাশ কবর থেকে বের করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
বিজ্ঞদের মুখে লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব
১৯ শতকের পর থেকে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা গ্রানাডার এই জ্ঞানতাপসের কাজ দেখে তাঁর প্রশংসায় বলেছেন, ‘the Sallust of the Kingdom of Granada’ বা ‘গ্রানাডার আরবি সাহিত্যের রাজপুত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
লিসানুদ্দিন খতিবের সংকলিত গ্রন্থাবলী
বিভিন্ন শাস্ত্রে লিসানুদ্দিন খতিবের সংকলিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ কয়েকটি গ্রন্থ হলো:
- ইতিহাস
১. গ্রানাডার আদ্যোপান্ত ইতিহাস ২. শিক্ষণীয় কর্মগাঁথা ৩. রাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিক সমাধান ৪. বনু নসর রাজ্যের দিনগুলো ৫. শাসকের জবানে মরুভূমির কাহিনি ৬. বনু নসর রাজ্যের স্বর্ণালী দিনগুলো।
- সাহিত্য
১. কবিতার কবিতা ২. বই নির্বাচনে কিছু স্বর্ণকথা ৩. স্কার্ফ বাহিনী ৪. যাদু ও কবিতা ৫. মেঘবৃষ্টি
এছাড়াও তাঁর সংকলিত আরও অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
ইবনুল খতিব রাহিমাহুল্লাহর ৭০০তম বার্ষিকী উদযাপন
২০১৩ সালে গ্রানাডার আল হামরা প্রাসাদ যাদুঘরের সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাসেবক কমিটি তাঁকে গ্রানাডার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং মানবিক দিকগুলো উল্লেখ করে একটি সাধারণ শ্রদ্ধা জানায়। ইবনুল খতিব রাহিমাহুল্লাহ সেসব ক্ষণজন্মাদের অন্যতম, যাদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্যের কাছে ইউরোপীয়ানরা চিরঋণী।