মরুসিংহ ওমর মুখতার। লিবিয়ার ইতিহাসের একজন অমর নায়ক। একজন মহান যোদ্ধা। উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে যিনি হয়ে আছেন অনুপ্রেরণা ও সাহসিকতার বাতিঘর। টানা ২০ বছর যিনি লড়ে গেছেন ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। ১৯৩১ সালে ফাঁসির মঞ্চে যাঁর শেষ আত্মত্যাগ আজও ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
নিজ সময়ের কিংবদন্তী ওমর মুখতারের জন্ম ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে লিবিয়ার জন্জুর গ্রামে। বাল্যকালেই মা বাবা হারানো শিশু ওমর মুখতার শিক্ষা অর্জন করেন লিবিয়ার ঐতিহ্যবাহী সুফি তরিকা সানুসি আন্দোলনের আলেম ও শায়েখদের তত্ত্বাবধানে। ইসলামি আইনের পাশাপাশি মুখস্থ করেন কুরআন। ফিকহ, হাদিস ও তাফসিরে অর্জন করেন গভীর দক্ষতা। ধৈর্য ও নৈতিকতার মহৎ গুণ তার সমাহার ঘটিয়েছিল নেতৃত্বের গুণাবলী। যা ওমর আল মুখতারের পরবর্তী জীবনে তৈরি সংগ্রামের ভিত্তি।
নেতৃত্বের আসনে উমর মুখতার
১৮৯৭ সালে ওমর মুখতার কাসুর অঞ্চলের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব লাভ করেন। ভূষিত হন ‘সিদি ওমর’ উপাধিতে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকাকালীন কাসুর অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় ওমর মুখতারের প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব ক্ষমতা তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রশংসা লাভ করে। নেতৃত্বের এই গুণ পরবর্তীতে ইতালীয়দের বিরুদ্ধে করা তার প্রতিরোধ লড়াইয়েও স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়।
সংগ্রামের সূচনা
১৯১১ সালে ইতালির সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধ শুরু হলে, লিবিয়ার কাসুর অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে ওমর মুখতার শুরু করেন সশস্ত্র প্রতিরোধ। পরবর্তীতে নিজ নেতৃত্ব দক্ষতায় ওমর মুখতার অবতীর্ণ হন লিবিয়ার উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান নেতার ভূমিকায়। তাঁর নেতৃত্বে লিবিয়ার স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা অভাবনীয় কৌশল প্রণয়ন এবং অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে একাধিক যুদ্ধফ্রন্টে ইতালীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনে।
ইতালীয়দের চোখে ওমর মুখতার
ওমর মুখতার শুধু লিবিয়ার জাতীয় বীরই ছিলেন না, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ওমর মুখতারের টানা ২০ বছরের লড়াইয়ে শত্রুরাও ছিল তাঁর যুদ্ধকৌশল, ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বে প্রভাবিত। তাঁর শত্রুরা তাঁকে শুধুমাত্র একজন বিদ্রোহী নেতা হিসেবেই দেখেনি, বরং একজন অসাধারণ যোদ্ধা, সুশৃঙ্খল কৌশলবিদ ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেছিল।
ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি ওমর মুখতার এবং লিবিয়ার স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা নেকড়েদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না। আমরা বরং সেসব সিংহদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, যারা তাদের দেশ রক্ষার জন্য সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করছে।’
ওমর মুখতারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার তত্ত্বাবধায়ক রোডলফো গ্রাজিয়ানি বলেন, ‘ওমর মুখতার ছিলেন তাঁর সময়ের এক কিংবদন্তি, যিনি হাজার বার মৃত্যুর হাত থেকে এবং বন্দিদশা থেকে বেঁচে গেছেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের কাছে পবিত্র এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন বার্কা অঞ্চলের আরব বিপ্লবের মূল চিন্তাবিদ এবং প্রাণশক্তি।’
গ্রাজিয়ানি আরও উল্লেখ করেন, ‘যখন তিনি আমার সামনে হাজির হন, আমার মনে হয়েছিল যে, আমি মরুভূমির যুদ্ধে দেখা হাজার হাজার বীরের মধ্যে একজনকে দেখছি। যদিও তিনি বন্দি অবস্থায় ছিলেন, তবুও তাঁর উপস্থিতিতে আভিজাত্যের ছাপ অটুট ছিল।’ রোডলফো গ্রাজিয়ানির এই উক্তি উমর মুখতারের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সবচে’ স্পষ্ট প্রতিফলন। যা শত্রুদের মনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
ওমর মুখতারের নেতৃত্বের প্রশংসায় তৎকালীন ইতালির পক্ষ থেকে নিযুক্ত ত্রিপোলির গভর্ণর পিয়েত্রো বাদোলিও বলেন, ‘ওমর মুখতার সেই কেন্দ্রবিন্দু, যার চারপাশে পুরো বিপ্লব আবর্তিত হয়েছে। তাঁর ক্ষমতা ছিল একচ্ছত্র এবং কেউই তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তাঁর অধীনে ছিল বিশ্বস্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিছু সহচর, যারা তাঁর প্রতিটি কথার কঠোর অনুসরণ করত। অন্য যেকোনো বিদ্রোহী আন্দোলনে নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ও হিংসা থাকে; সেখানে ওমর মুখতারের নেতৃত্বের অধীনে এ ধরনের কোন কিছুই দেখা যায়নি।’ বাদোলিও আরও বলেন, ‘ওমর মুখতারের দৃঢ় ইচ্ছাই ছিল আইন এবং তাঁর ইচ্ছার বিপক্ষে চলত না কিছুই’।
তাঁর প্রতিরোধের কার্যক্রম এতটাই সংগঠিত ছিল যে, তাঁর শক্তি ও নেতৃত্বের গভীর প্রভাব সম্পর্কে ইতালীয় শাসকদের সদা সচেতন থাকতে হত। ইতালীয় শাসকরা তাঁর শৃঙ্খলা ও কৌশলকে সত্যিই ভয় পেত।
শেষ প্রতিরোধ এবং বন্দিত্ব
ইতালীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মরুসিংহ ওমর মুখতার প্রায় অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর ১৯৩১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, ইতালীয়রা তাদের উপাধি দেওয়া ৭৩ বছর বয়সী মরুসিংহকে বন্দী করতে সক্ষম হয়।
ওমর মুখতারকে বন্দী করার পর উপহাসমূলক একটি বিচারের মাধ্যমে মহান এই যোদ্ধাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এবং সবশেষ ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে হাজার হাজার লিবিয়ানের সামনে ওমর মুখতারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয়। শহিদ হওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করি না। আমরা বিজয় অর্জন করি বা মৃত্যুবরণ করি।’
ওমর মুখতারের উত্তরাধিকার
সাধারণত মানুষ তার পরবর্তীদের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে কিছু সম্পদ রেখে যায়। কিন্তু ওমর মুখতার পরবর্তীদের জন্য কোন সম্পদ রেখে যাননি। ওমর মুখতার উত্তরাধিকার হিসেবে একটি মাত্র জিনিস রেখে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পিপাসা আর লড়াইয়ের মানসিকতা।
সূত্র: আল জাজিরা অ্যারাবিকের একাধিক ফিচার অবলম্বনে