রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার দাবিতে মানবন্ধন করেছে ইউনাইটেড ইয়ুথ মুভমেন্ট বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রায় শতাধিক মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে এই মানববন্ধন পালিত হয়।
এ সময় আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার দাবি জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন সংগঠনের সভাপতি ও সেক্রেটারি। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের এ সময় নানা দাবি সংবলিত বিভিন্ন ফেস্টুন উঁচিয়ে থাকতে দেখা যায়।
ইউনাইটেড ইয়ুথ মুভমেন্ট বাংলাদেশের সেক্রেটারি তৌফিক এলাহী তার বক্তব্যে বলেন, ‘প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ, আপনারা অবশ্যই জেনে থাকবেন যে, আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একটি জাতি রয়েছে, যারা প্রায় শত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়ে আসছে। যাদের নাম চির নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের আরাকান রাজ্য তাদের আদি নিবাস। অথচ আজ নিজ দেশেই তারা অবাঞ্চিত। কেবল মুসলিম হওয়ার অপরাধেই, শত বছর আগে থেকে তাদের উপর যে নির্যাতন শুরু হয়েছে, তা আজো থামেনি। শিক্ষা-দীক্ষা ও নিজ ধর্ম পালনের অধিকার থেকে শুরু করে সব ধরনের নাগরিক ও মানবিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হতে কোণঠাসা হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ আজ নিকষ কালো আঁধারে মিশে গেছে।

প্রিয় বন্ধুগণ, রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিগত নিধনের শিকার হওয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহ্যবাহী আরাকান রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করে ফেলা। সেই ধারাবাহিকতায় আজো আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বিরামহীন নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই ও লুটপাট চলছে অহরহ। গত একশত বছরে আরাকান রাজ্যে কি পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। আপনারা জানেন, বিগত ২০১৭ সালে মায়ানমারের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী জান্তা বাহিনী ও মগ সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির পরিচালিত সম্মিলিত গণহত্যায় ৩৬ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মা-বোনকে ধর্ষণ করা হয়। সেই বর্বরতম গণহত্যা থেকে বাঁচতে সেসময় প্রায় ১ মিলিয়নেরও অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।’
তৌফিক এলাহী তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘২০১৭ সালের সেই বিভীষিকাময় রোহিঙ্গা গণহত্যায় যে সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলো, তারাই হল আজকের আরাকান আর্মি। আর এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পূর্বসূরীরাই ছিল সেই কুখ্যাত মগ জলদস্যু, যারা বিগত কয়েকশ বছরে বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বাঙ্গালী জেলে ও ব্যবসায়ীদের কিডন্যাপ করে বিভিন্ন দেশে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই শত শত বছর আগে থেকেই এই মগ সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করার মাধ্যমে আরাকান রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করার ভয়াবহ চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। সেই মগ জলদস্যুদের উত্তরসূরী হিসেবে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মিও আজ একই কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি তাদের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আরাকান থেকে জোরপূর্বক হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যে কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে সীমান্তে ভিড় করছে, অথচ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কখনোই চায় না যে, তারা বাংলাদেশে থাকুক। তারা প্রত্যেকেই নিজ ভূমি আরাকানে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে ফিরে যেতে চায়।’

তৌফিক এলাহী তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪৮টিরও অধিক রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। যার ফলে আরাকানে ১৭০,০০০ থেকে ১৮০,০০০০ হাজার নতুন বাস্তচ্যুত মানুষ তৈরি করেছে। এছাড়াও এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পাঁচ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে এই স্বল্প সময়ে। গতমাসের ৪ ও ৫ তারিখে আরাকানের মংডু শহরে ড্রোন এটাক চালিয়ে ২০০ এরও অধিক রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে। সেই সাথে অগনিত রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছে এই সন্ত্রাসীরা। গণহত্যা ও ধর্ষণের পাশাপাশি সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি বিগত ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার নিরীহ রোহিঙ্গাকে আন্তর্জাতিক মানব পাচার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিয়েছে। আরো ভয়ানক ব্যপার হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচারের মূল কারিগর হল এই আরাকান আর্মি। ড্রাগ কন্ট্রল অথরীটি অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, বাংলাদেশে তারা প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করে থাকে, যার ফলে আমাদের সমাজের তরুণ – যুবকরা ইয়াবার প্রতি আসক্ত হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়াও মেথামফেটামিন ও আফিমের মতো ভয়ানক মাদকদ্রব্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের মাধ্যমে এই আরাকান আর্মি লক্ষ লক্ষ ডলার আয় করছে, আর আমাদের সমাজ তার মূল্য দিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের
সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি বাংলাদেশে কেবল মাদক পাচার করেই থেমে যাচ্ছে না, বরং তাদের পরিকল্পনা আরো অনেক গভীরে। আরাকানের পুরো অঞ্চল দখল করে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপথগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করাও তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে বলতে চাই, সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি বর্তমানে উপজাতিদের থেকে নিয়মিতভাবে সৈন্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। এটি আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অনেক বড় অশনি সংকেত। আমরা এভাবে চলতে দিতে পারি না।
ইউনাইটেড ইয়ুথ মুভমেন্ট বাংলাদেশের সভাপতি দায়ীফ সালেমুন তার বক্তেব্যে বলেন,‘ আরাকান আর্মি যে শুধু রোহিঙ্গাদেরই শত্রু, বিষয়টি মোটেই এমন নয়। আমাদের সম্মানিত সেক্রেটারি ইতোমধ্যে বলেছেন যে, এই সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীগুলো থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে তাদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে এবং তাদের হাতে বিভিন্ন মরণাস্ত্র তুলে দিয়ে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার ঘৃণ্য চক্রান্ত শুরু করেছে। সুতরাং আমরা যদি সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন না করি, তবে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে যেকোনো সময়।

এখন আসি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে। আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও একমাত্র সমাধান হল – তাদের নিজস্ব ভূমিতে, অর্থাৎ আরাকানে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া। তবে সেই ফিরিয়ে নেয়াটা হতে হবে নিরাপত্তা ও পূর্ণ অধিকারের সাথে। এটি কেবল রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও একমাত্র টেকসই সমাধান। তবে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। যদিও তারা কূটনৈতিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু আমরা মনে করি তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তাদের উচিৎ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির উপর আরো শক্তিশালী ও কার্যকর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তাদেরকে মিয়ানমারে সসম্মানে ফিরিয়ে নেয়। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান কর্তৃপক্ষের উচিৎ হল— আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করার পাশাপাশি নিজেদের শক্ত অবস্থান স্পষ্ট করা। নয়তো রোহিঙ্গা সংকট ঢেকে যাবে গভীর অমানিশায়।’
সবশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ৫ টি দাবি উত্থাপন করেন সংগঠনের সভাপতি দায়ীফ সালেমুন। তিনি বলেন, ‘সবশেষে, আমরা ইউনাইটেড ইয়ুথ মুভমেন্ট বাংলাদেশ আরাকান আর্মি কর্তৃক রোহিঙ্গা গণহত্যা, শরণার্থী সংকট এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের কিছু দাবি উপস্থাপন করছি—
১. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের উপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে তারা রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
২. আরাকান আর্মিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে। তাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ, সমন্বয় বা সহযোগিতা করা যাবে না।
৩. সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে।
৪. প্রত্যাবাসনোত্তর এই সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান আর্মি যেন রোহিঙ্গা জনগনের উপর নতুন কোন হুমকি সৃষ্টি না করতে পারে সে দিকে আন্তর্জাতিক মহলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৫. বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি কর্তৃক অবৈধ মাদক ও অস্ত্র পাচার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়াতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
সময় এসেছে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হওয়ার। আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।’