‘বিগত দুই দশকের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য এখন অনেক শান্ত,’— ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত ম্যাগাজিনে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্সে’এমন মন্তব্য করেছিলেন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান। কিন্তু ঠিক ৯দিন পরেই ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবং সুলিভানকে তার বক্তব্য সংশোধন করতে হয়। আমেরিকাকে একইসাথে কৌশলগত ৩টি বৃহৎ সমস্যা সামলানো শুরু করতে হয়।
২০১৭ সাল থেকেই আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা নীতিগুলো পুনরায় বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপর জোর দিয়েছেলো। যে নীতিতে চীনকে আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কারণ, ইতিমধ্যেই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে চীন পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করেছিলো। অন্যদিকে রাশিয়াও তার পুরোনো পরাশক্তির অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় বহুদুর এগিয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য বারাক ওবামার শাসনামল থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। যাতে সেই সামরিক ক্ষমতাগুলো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুনর্বিন্যস্ত করা যায়। আমেরিকার ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার অন্যতম কারণও ছিল এটা।
জ্যাক সুলিভান, যিনি আমেরিকার নিরাপত্তা নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল অনুমান করেছিলেন। কিন্তু তিনি একা নন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিআইএ প্রধান মাইক পম্পেও তার স্মৃতিকথায় বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। পম্পেও পূর্ববর্তী ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কৌশল তৈরির চেষ্টা করেছিলেন যাতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সেনা মোতায়েন না করতে হয়। কিন্তু বিধিবাম, ২০২৪ সালে আমেরিকাকে আবারও মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে হয়, এমনকি সমুদ্র এবং আকাশপথেও বেশ কয়েকটি অপারেশন চালাতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে ইরাক সিরিয়া এবং ইয়েমেনে হামলা। এছাড়া, ইরান বিরোধী শক্তির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমেরিকাকে ফের মধ্যপ্রাচ্যে তার সম্পৃক্ততা বাড়াতে হয়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকাও ক্ষতির সম্মুখিন হয়। জর্ডানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা যার প্রমাণ।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নতুন করে জড়িয়ে পড়া এবং একই সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের মোকাবিলা করার কারণে ওয়াশিংটনে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিনটি ভিন্ন ফ্রন্টে আমেরিকার সম্পৃক্ততা তার সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। কৌশলগতভাবে এটি আমেরিকার জন্য একটি দেউলিয়া নীতির শামিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটিকে তার সামগ্রিক কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে ‘বিগ স্ট্র্যাটেজি’ নির্ধারণ করা উচিৎ। যাতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে সম্পদ নষ্ট না হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমেরিকার বিগ স্ট্র্যাটেজি কী?
আমেরিকার অগ্রাধিকারপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি আছে কি?
‘বিগ স্ট্র্যাটেজি’ শব্দটির প্রথম উৎপত্তি ২০ শতকে। ‘বিগ স্ট্র্যটেজি’ পরিভাষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ পল কেনেডি মনে করেন, এটি এমন সম্পদ যা একটি পরাশক্তি বিশ্বে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য ব্যয় করে। অন্যদিকে, অধ্যাপক পিটার ফেভার আরও বিস্তৃতভাবে এটি সংজ্ঞায়িত করেন। তার মতে, এটি মূলত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতির সমন্বয় যা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক, ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগায়।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগ স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে বিশ্লেষকদের মতামত হচ্ছে, আমেরিকার বৃহৎ কৌশল হলো তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সম্পদ এবং প্রতিশ্রুতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। যা রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে একটি সুসংগত পরিকল্পনার অধীনে পরিচালিত করে। কিন্তু অনেকে আবার এর আপত্তি করেন। তাদের মতে, বিশ্বের পরিস্থিতি বরাবরই অনিশ্চিত এবং অপ্রত্যাশিত। ফলে ‘বৃহৎ কৌশল’ বাস্তবে অকার্যকর হতে পারে, কারণ ঘটনাবলী এবং নতুন চ্যালেঞ্জের ওপর তা নির্ভর করে। তাই আমেরিকার বিগ সট্র্যাটেজি যে মাঠে মারা যাবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কতটুকু?
সোভিয়েত পতনের পর নতুন চ্যালেঞ্জ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার প্রধান কৌশল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা এবং ইউরেশিয়াতে কোনো শক্তি যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ইউরেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি সহজেই আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার লক্ষ্য ছিল অন্য কোনো শক্তিকে ইউরেশিয়ায় এমন প্রভাব বিস্তার করতে না দেওয়া।
সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলের উত্থান এবং পতন
৯/১১-এর হামলার পর আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ নতুন কৌশল হয়ে ওঠে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে এবং ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের মাধ্যমে যেই যুদ্ধ তার সর্বোচ্চ মাত্রায় গিয়ে পৌছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ ছিল আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ, যা প্রায় ২০ বছর ধরে আমেরিকাকে চালিয়ে নিতে হয়েছে। অন্যদিকে, ইরাকের যুদ্ধ আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষয় ঘটিয়েছে।
ওয়ার অন টেররের সূচনাকারী প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ভেবেছিলেন, আমেরিকা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি, এবং সেই শক্তি তাকে প্রতিটি যুদ্ধে জয়ী করবে। কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা দু’টি যুদ্ধে পরাজিত হয়, এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বাড়াতে থাকে।
চীন ও রাশিয়ার উত্থান
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে আমেরিকা উপলব্ধি করে যে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কারণে চীন ও রাশিয়া তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বহুদুর এগিয়ে গেছে। ওবামা তাই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অধিক মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা চীনের প্রভাব রোধের একটি কৌশল ছিল।
এরপর ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীনকে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চীনের পাশাপাশি রাশিয়াকেও বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে বাইডেন প্রশাসনও এই কৌশল অব্যাহত রাখে এবং চীনকে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে।
আমেরিকার ভবিষ্যৎ কৌশল কী?
২০২৪ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকার কৌশল কী হবে, তা নিয়ে এখন জল্পনা শুরু হয়েছে। ট্রাম্প আবারও ইউক্রেনের প্রতি সামরিক সহায়তা কমানোর এবং চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার এই অবস্থান মিত্র দেশগুলোর মধ্যে আশঙ্কা সৃষ্টি করছে আমেরিকা হয়তো তাদের বিশ্ব কৌশল থেকে সরে আসবে।
সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমেরিকার জন্য নিজ শক্তি ও প্রভাব রক্ষা করা এখন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। তাই মার্কিন নেতৃত্বের জন্য ভবিষ্যতের কৌশলগত অগ্রাধিকার কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
সূত্র: আল জাজিরা