প্রায় বছর ধরে নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত। সামনে এসেছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের চলমান তীব্র উত্তেজনার নতুন এক প্রতিফলন। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা এবং লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালিয়ে একের পর এক হিজবুল্লাহ ও হামাসের শীর্ষ নেতাকে হত্যা করছে ইসরায়েল। সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরা ইসরায়েলের কিলিং মিশনে হিজবুল্লাহ এবং হামাসের নিহত নেতাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। যাতে শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সংঘাতে নিহত হওয়া নেতাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যা
ইব্রাহিম কুবাইসি
ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া হিজবুল্লাহর নেতৃবৃন্দের মধ্যে একেবারে সাম্প্রতিক শিকার ছিলেন ইব্রাহিম কুবাইসি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর, বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন কুবাইসি। উল্লেখ্য, ইব্রাহিম কুবাইসি ছিলেন হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার প্রধান।
মুহাম্মদ হুসেইন সারুর
ইসরায়েলি বিমান হামলায় গত ২৬শে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মুহাম্মদ হুসেইন সারুর নামের হিজবুল্লাহর আরেক শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হন। নিহত এই কমান্ডার হিজবুল্লাহর বিমানশক্তি ইউনিটের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ইব্রাহিম আকিল
দিনটি ছিল চলতি মাসের ২০ সেপ্টেম্বর। ইসরায়েলের একটি সফল বিমান হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর সামরিক কার্যক্রমের প্রধান ইব্রাহিম আকিল। ইব্রাহিম আকিল হিজবুল্লাহর সর্বোচ্চ সামরিক সংগঠন ‘জিহাদ কাউন্সিল’ এর সদস্য ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালে বৈরুতে মার্কিন দূতাবাস বোমা হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারীরূপে কাজ করার অভিযোগ ছিল।
আহমেদ ওয়াহবি
একই দিনে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর আরেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা আহমেদ ওয়াহবি। তিনি হিজবুল্লাহর অভিজাত ‘রিদওয়ান ফোর্সের’ সামরিক কার্যক্রমের প্রধান ছিলেন।
ফুয়াদ শকর
এর আগে ৩০ জুলাই, ইসরায়েলের একটি আক্রমণে হিজবুল্লাহর অন্যতম প্রধান সামরিক নেতা ‘ফুয়াদ শকর’ নিহত হন। উল্লেখ্য, ফুয়াদ শকর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর “ডানহাত” হিসেবে পরিচিত ছিল। একেবারে হিজবুল্লাহর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সংগঠনটির সঙ্গে ওতপ্রোতভবে সম্পৃক্ত ছিলেন ফুয়াদ শকর। ১৯৮৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মার্কিন মেরিন ব্যারাকে হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছিল।
মোহাম্মদ নাসের
৩ জুলাই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর এই শীর্ষ নেতা। এই মোহাম্মদ নাসেরই ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিম লেবানন থেকে ইসরায়েলে হামলার নেতৃত্বদাতা।
তালিব আবদুল্লাহ
চলতি বছরের জুন মাসের ১২ তারিখ। ইসরায়েলের আরেকটি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ ফিল্ড কমান্ডার তালিব আবদুল্লাহ নিহত হন। তার এই হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ব্যাপক রকেট হামলা চালায়।
মোহাম্মদ সুরুর
মোহাম্মদ সুরুর, তিনি হিজবুল্লাহর ড্রোন ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, একটি ইসরায়েলি আক্রমণে তার মৃত্যু হয়। তবে হিজবুল্লাহ এখনও তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যা
ইসমাইল হানিয়া
হামাসের ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক সময়ে একই ধরনের আক্রমণ চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
গত ৩১শে জুলাই, আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে ইরানের রাজধানী তেহরানে নৃশংস এক হামলা চালিয়ে হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে শহিদ করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলার পর হামাস এক বিবৃতিতে ইসমাইল হানিয়ার শাহাদাতের খবর নিশ্চিত করে। বিবৃতিতে হামাস জানায়, ইসমাইল হানিয়া ‘একটি কাপুরুষোচিত ইসরায়েলি হামলায়’ শহীদ হয়েছেন। যদিও ইসরায়েল এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। কিন্তু এই হামলায় ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার শক্ত প্রমাণ রয়েছে।
সালেহ আল আরুরি
এর আগে, চলমান গাজা যুদ্ধের মাত্র ৩ মাসের মাথায় ২ জানুয়ারি ২০২৪ সালে, ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় শহিদ হন হামাসের উপ-রাজনৈতিক প্রধান সালেহ আল-আরুরি। উল্লেখ্য, সালেহ আল-আরুরি ছিলেন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন।
মোহাম্মদ আদ-দাইফ
হামাসের সাম্প্রতিক সময়ে শহিদ হওয়া শীর্ষ নেতাদের তালিকায় আলোচিত ছিল হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ আদ-দাইফ-এর নামও। ইসরায়েল দাবি করেছিল, ১৩ জুলাই খান ইউনুসে একটি বিমান হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু হামাস বারবার এই দাবি অস্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে মোহাম্মদ আদ-দাইফ এখনও জীবিত আছেন এবং হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
হুসাইন মাহমুদ নাদের
লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শহিদ হওয়া হামাসের আরেক নেতা হলেন হুসাইন মাহমুদ নাদের। হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দীন কাসসামের ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন হুসাইন মাহমুদ। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার শহিদ হওয়ার বিষয়টি হামাসের সামরিক শাখার অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেল আল ইলামুল আসকারির এক পোস্টে নিশ্চিত করা হয়।
ইসরায়েলের এসব হামলার ফলাফল
এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ-হামাসের মধ্যে সংঘাতকে হ্রাস না করে আরও তীব্র করে তুলছে। এধরণের প্রত্যেকটি হামলার পরপরই হামাস ও হিজবুল্লাহ উভয়ই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে , ইসরায়েলের এধরণের মানবতা বিবর্জিত হামলা সংঘাতকে নিশ্চিতরূপে আরও দীর্ঘায়িত করবে এবং এসব হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আরও হুমকির মুখে পড়বে ।
হিজবুল্লাহ ও হামাসের শীর্ষ নেতাদের ওপর এসব আক্রমণ ইসরায়েলের জন্য একটি কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখা হলেও, আদতে এর ফলে ইসরায়েল-লেবানন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের উত্তেজনা আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স