ষোড়শ শতক। ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিবেশ তখন উত্তাল। দুই মহাশক্তিধর সাম্রাজ্য স্পেন ও ফ্রান্সের সংঘাত ইউরোপকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সেই সময়ের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘিড়েই অবতারণা হয় এক অবিস্মরণীয় ঘটনার। যেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল ইউরোপের রাজনীতি, ধর্ম এবং আধিপত্যের লড়াইয়ে ভরা এক পর্ব, যা আজও ইতিহাসপ্রেমীদের মধ্যে কৌতূহলের জন্ম দেয়। তৎকালীন ফরাসি রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া সেই সময়ের পরাশক্তি উছমানি সাম্রাজ্যের শক্তিমান উছমানি সুলতান সুলেমান আল কানুনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল যার জন্য একজন খ্রিস্টান রাজা ইসলামের বৃহত্তম শক্তির কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান?
ইউরোপের রাজনৈতিক পটভূমি
১৬শ শতকে ইউরোপে দুটি প্রধান শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। ফ্রান্সের রাজা ফ্রাঁসোয়া প্রথম এবং রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ও স্পেনের রাজা চার্লস পঞ্চম। চার্লসের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্য ছিল একটি বিশাল ভূখণ্ড, যা স্পেন, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস এবং ইতালির অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল। বিশাল এই সাম্রাজ্যের বিপরীতে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া চেয়েছিলেন ইতালির উত্তর অংশের মিলানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে, যেগুলো রাজা চার্লস ফ্রান্স থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।
ইউরোপের ইতিহাসে এই সংঘাতকে ‘ইতালিয়ান যুদ্ধ’ বলা হয়, যা ১৪৯৪ থেকে ১৫৫৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল। তৎকালীন ইতালির খণ্ডিত নগর-রাষ্ট্রগুলো যেমন—বেনিস, জেনোয়া, ফ্লোরেন্স, এবং মিলান, ছিল অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু পোপের ক্ষমতা সেখানে কেন্দ্রীভূত ছিল, তাই ইতালির ওপর নিয়ন্ত্রণ মানে শুধু রাজনৈতিকভাবে ফায়দাজনক ছিলনা। এটি ইউরোপের ধর্মীয় প্রতিপত্তি অর্জনেরও মাধ্যম ছিল।
ফ্রাঁসোয়ার পরাজয় এবং বন্দীত্ব
ষোড়শ শতকে ফরাসি রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া এবং চার্লস পঞ্চমের মধ্যে এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইতালির উত্তরাঞ্চল। ১৫২১ সালে ফ্রান্স মিলান পুনরুদ্ধার করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় এবং চার্লসের বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়। কিন্তু সবচেয়ে করুণ ঘটনা ঘটে ১৫২৫ সালে পাভিয়ার যুদ্ধে। ফ্রাঁসোয়ার নেতৃত্বাধীন ফরাসি বাহিনী চার্লসের সেনাবাহিনীর কাছে চূর্ণবিচূর্ণ হয়, এবং স্বয়ং সম্রাট ফ্রাঁসোয়া চার্লসের কাছে বন্দী হন।
এই পরাজয়ের পর ফ্রাঁসোয়াকে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে নিয়ে একটি অপমানজনক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। ‘মাদ্রিদ চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তির শর্তাবলির মধ্যে ছিল মিলান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডের ওপর ফ্রান্সের দাবির ত্যাগ। চুক্তির অধীনে ফ্রাঁসোয়াকে বাধ্য করা হয় তার দুই সন্তানকে জিম্মি হিসেবে স্পেনে পাঠাতে। যার ব্যাপারে স্বয়ং ফ্রাঁসোয়া তার মাকে লেখা একটি চিঠিতে এভাবে উল্লেখ করেন; ‘সবকিছু হারিয়েছি, তবে সম্মান এবারও রক্ষা করতে পেরেছি।’
সুলতানের কাছে সাহায্যের আবেদন
মুক্তি পাওয়ার পর সম্রাট প্রথম ফ্রাঁসোয়া মাদ্রিদ চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বুঝতে পারছিলেন, চার্লস পঞ্চমের শক্তিকে মোকাবিলা করতে হলে তাকে নতুন কোন শক্তিশালী মিত্রের সন্ধান করতে হবে। আর সেই মিত্রের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি দ্বারস্থ হন অটোমান সাম্রাজ্যের দরবারে।
তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র উছমানি সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন সুলাইমান আল-কানুনী। ইউরোপের ইতিহাসে দ্য ম্যাগনিফেসেন্ট হিসেবে পরিচিত শক্তিমান এই সুলতানের নেতৃত্বে উছমানি সাম্রাজ্য তখন পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এবং উত্তর আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করেছিল। ফলে পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলে উছমানিয়দের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং স্প্যানিশ রাজা চার্লস পঞ্চমের বিরুদ্ধে উছমানিয়দের ক্রমাগত আক্রমণ ফরাসি সম্রাট ফ্রাঁসোয়ার জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্রাঁসোয়া প্রথম সুলতান সুলেমানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আর সাহায্য পাওয়ার জন্য সম্রাট ফাঁসোয়া এতটাই মরিয়া ছিলেন, সুলতান সুলাইমানকে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা চিঠিতে ফ্রাঁসোয়া সুলতান সুলাইমানকে ‘বিশ্বের অধিপতি’ হিসেবে সম্বোধন করেন এবং তার কঠিন অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, একমাত্র অটোমান সাম্রাজ্যই তাকে রক্ষা করতে পারে। কারণ, ইউরোপের কোনো শক্তিই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি
সুলতান সুলেমানের প্রতিক্রিয়া
ফ্রাঁসোয়ার চিঠির প্রতিক্রিয়ায় সুলতান সুলেমান প্রথমে ফ্রান্সের পরিস্থিতির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং তাকে আশ্বস্ত করেন অটোমান সাম্রাজ্য তার পাশে থাকবে। সুলতান ফ্রাঁসোয়াকে বলেন, ‘রাজাদের জন্য বন্দিত্ব নতুন কিছু নয়। আপনার মনোবল বজায় রাখুন। আমাদের বাহিনী প্রস্তুত এবং শীঘ্রই বিজয় আসবে।’
অবশ্য সুলতান সুলাইমান কর্তৃক ফরাসি সম্রাট ফ্রাঁসোয়ার জন্য সহানুভূতি প্রকাশ, শুধুমাত্র সহানুভূতি প্রদর্শনই ছিলোনা। সুলতান সুলাইমান এই সম্পর্ককে কৌশলগত সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, স্প্যানিশ রাজা পঞ্চম চার্লস শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যের জন্যও হুমকি ছিল। তাই ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতা উছমানিয়দের জন্যও লাভজনক ছিল। ফলে সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে দুই ভিন্নধর্মী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সামরিক সম্পর্ক গরে ওঠে ।
অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক সহযোগিতা
ফ্রাঁসোয়ার সাহায্য প্রার্থনার পর, সুলতান সুলাইমান পঞ্চম চার্লসের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান শুরু করেন। ১৫২৬ সালে অটোমান বাহিনী মাজারের যুদ্ধে ভয়াবহভাবে হাঙ্গেরির সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং বালকান অঞ্চলে অটোমান প্রভাব সুদৃঢ় করে।
এরপর ১৫২৯ সালে সুলতান স্বয়ং ভিয়েনা অবরোধ করেন। ভিয়েনার এই অবরোধ উছমানি সাম্রাজ্যকে পশ্চিম ইউরোপে বিস্তারের একটি প্রধান পদক্ষেপ ছিল। যদিও শীতের কারণে উছমানিয়রা শহরটি দখল করতে ব্যর্থ হয়, তবুও এ পদক্ষেপ সম্রাট পঞ্চম চার্লসের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, সুলতান সুলাইমান ভূমধ্যসাগরে তার সমুদ্রশক্তিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হন। উছমানি নৌবাহিনীর অধিনায়ক খায়রুদ্দিন বারবারোসা স্পেন ও ইতালির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল নৌ-অভিযান পরিচালনা করেন। ১৫৪৩ সালে ফরাসি ও উছমানিয় নৌ বাহিনী একসঙ্গে অভিযান চালিয়ে নীস শহর পুনরুদ্ধার করে। এরপর থেকেই, ফরাসি সমুদ্রবন্দর ‘তুলন’ উছমানিয়দের জন্য শীতকালীন ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ফলে পশ্চিম ইউরোপের কোন অঞ্চলে সর্ব প্রথম অটোমান পতাকা উড়ে এবং আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে।
ফ্রান্স-উছমানি সাম্রাজ্য মিত্রতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ফরাসি সম্রাট প্রথম ফ্রাঁসোয়া এবং সুলতান সুলেমানের এই মিত্রতা ইউরোপে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করে। ফ্রান্সের পরবর্তী রাজা হেনরি দ্বিতীয়ও এই মিত্রতা বজায় রাখেন এবং উছমানিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করেন।
উছমানিয় সাম্রাজ্যের জন্য এই মিত্রতা শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকেও লাভজনক ছিল। ইউরোপের অন্যান্য খ্রিস্টান শক্তির মধ্যে ফ্রান্সকে নিজেদের পাশে পাওয়া অটোমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
মোটকথা ফ্রাঁসোয়া প্রথমের সুলতান সুলেমান আল কানুনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা শুধুই সামরিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না; এটি ছিল সেই সময়ের ইউরোপীয় রাজনীতির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সীমারেখা ভাঙার এক উদাহরণ। ফ্রান্সের মতো একটি খ্রিস্টান দেশের উছমানি সাম্রাজ্যের মতো ইসলামী শক্তির সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলা, প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
সূত্র: আল জাজিরা ও বিভিন্ন ওয়েব সাইট