নিউজনেস্ট

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মৃত্যুপুরী ‘ওয়াদি আস সালাম’

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মৃত্যুপুরী 'ওয়াদি আস সালাম'
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মৃত্যুপুরী 'ওয়াদি আস সালাম’। ছবি: অ্যটলাস ইসলামিকা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে অসংখ্য বিখ্যাত কবরস্থান, যেগুলো স্থান পেয়েছে ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে। বাংলাদেশের আজিমপুর কবরস্থান, পাকিস্তানের মকলি কবরস্থান, মদিনার জান্নাতুল বাকী, মক্কার জান্নাতুল মুআল্লা এবং ভারতের আজমীর শরীফের মতো বহু স্থানই পরিচিত তাদের ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে। তবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কবরস্থান কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে উঠে আসে এক বিশেষ নাম- ইরাকের ‘ওয়াদি আস সালাম’ বা ‘শান্তির উপত্যকা’।

শান্তির উপত্যকার ছোট্ট চিত্র

এই কবরস্থানটি প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন এবং প্রায় দেড় হাজার একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে শায়িত আছেন প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ। যার মধ্যে রয়েছেন বহু নবী, বিখ্যাত শাসক, রাজপুত্র, পণ্ডিত এবং বণিকগণ। মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, নবী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা হযরত আলী রাজিয়াল্লাহু আনহু এই কবরস্থানে শায়িত সবচেয়ে বিশিষ্টদের একজন।

বিশ্বজুড়ে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করেন, এখানে সমাধিত হওয়া মানে কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর কাছে হযরত আলী রাজিয়াল্লাহু আনহু এর সুপারিশ প্রাপ্তি। তাই ইরাক ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লেবানন, ইয়েমেন; এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা তাদের স্বজনদের এই পবিত্র স্থানে সমাহিত করতে নিয়ে আসেন।

শিয়া মতাবলম্বীরা এই কবরস্থানে তাদের নিজস্ব রীতি অনুসারে কবরের উপর সমাধি স্তম্ভ নির্মাণ করে। উপরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটি প্রাচীন ইট-পাথরের নগরী, যা নীরবতায় ঢেকে আছে। কিন্তু নিকটে গিয়ে বোঝা যায়, এটি এক বিশাল মৃত্যুপুরী, যেখানে প্রতিটি সমাধিস্থল নীরব ভাষায় বলে চলে ইতিহাসের গল্প।

মৃত্যুপুরী শান্তির উপত্যকায়লাশের মিছিল:

বিংশ শতকে প্রতি বছর এখানে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে কবর দেওয়া হতো। বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লক্ষে। ২০০৩ সালে এই শান্তির উপত্যকা এক ঐতিহাসিক মোড় নেয়। সাদ্দাম হোসেনের শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে, যা পরিণত হয় দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।

ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২০০৩ সালের ২০শে মার্চ। তৎকালীন ইরাক শাসক সাদ্দাম হোসেনের শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য আমেরিকা ইরাকের উপর হামলা চালায়। এরপর নানাভাবে ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ২০০৪ সালে মাহদি আর্মি ও আমিরিকান বাহিনীর সাথে ২২ দিন ধরে তীব্র লড়ায় হয়। এ লড়াইয়ে ইরাকের প্রায় ৩০০ মানুষ নিহত হয়।  

এরপর এক মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে ২০০৬-০৮ সালে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে প্রায় ৬৯ হাজার ৭০৬ জন ইরাকি মারা যায়। এরপর ২০০৮ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সদর সিটি অবরোধ নামে আরেক দ্বন্দ্বে প্রায় ১,১০০ জন ইরাকি মারা যায়। ফলে ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এ জাতীয় সংঘাতে এই অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা বিরাজ করে। আর ওয়াদি আস সালাম প্রত্যক্ষ করে লাশের মিছিল।

যুদ্ধে নিষ্প্রাণের ঠাঁই যখন প্রাণ রক্ষার ঢাল

ইরাক যুদ্ধে এটি শুধু মরদেহের কবরস্থানই ছিলো না, বরং ইরাকি যোদ্ধাদের জন্য হয়ে উঠেছিলো এক রণকৌশলের ক্ষেত্র। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর জন্যও এই কবরস্থান ছিল কৌশলগত এক নিরাপদ আশ্রয়। সরু, অন্ধকার কুঠুরিতে তারা তাদের ঘাঁটি স্থাপন করত এবং শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত।

বহুবার মার্কিন সেনাবাহিনী এবং ন্যাটো বাহিনী এই অঞ্চল দখল করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু যুদ্ধের শেষে এই ঐতিহাসিক কবরস্থানের অনেকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়, যা ইরাকের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

‘ওয়াদি আস সালাম’ এখন কেবল একটি কবরস্থান নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে শায়িত মানুষদের পাশাপাশি লুকিয়ে আছে ইরাকের যুদ্ধ, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বেদনাদায়ক স্মৃতির গল্প।

শাহাদাত হুসাইন
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত