ডিসেম্বরের এক শীতল রাত। মুহাম্মদ সালেমের জন্মের দিন। চারিদিকে ইসরায়েলি স্নাইপার এবং ট্যাংকের আনাগোনা— মৃত্যুর পরওয়ানা নিয়ে ঘুরছে তাকদির। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে গাজার শেখ রিদওয়ান এলাকায় মা শাইমা একটি বাড়ির কোণে জন্ম দেন মুহাম্মদকে। নূন্যতম কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই, কেবল সন্তানকে পৃথিবীতে আনার মাতৃত্বপূর্ণ আকুতি।
সালেমের মামা হুসাম সালেম দীব বলেন, ‘ওর জন্মপ্রক্রিয়া সহজ ছিল না। দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা কষ্টের পর জন্ম হয় মুহাম্মদের। সেই সময় মনে হয়েছিল, ওকে পৃথিবীতে আনার পরই যেন সমস্ত বাঁধা কেটে যাবে। তবে নিয়তি যেনো তার পরিবারকে একটি নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
মাত্র আট দিন পর, সকালে মুহাম্মদের পরিবার যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেটি ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। আক্রমণে প্রাণ হারায় মুহাম্মদের মা, বাবা, এবং ভাইবোনেরা। মুহাম্মদ হয়ে যায় সালেম পরিবারের একমাত্র জীবিত সাক্ষী।
হামলার পর ধুলোমাখা মুখে যখন মুহাম্মাদের মামা তাকে উদ্ধার করেন—তার শ্বাস আটকে আসছিল বারবার। তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদকে দ্রুত ক্লিনিকে নিয়ে যাই।ক্লিনিকে তার পাকস্থলী পরিষ্কার করা হয় এবং অক্সিজেন দেওয়া হয়। মুহাম্মদ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে।আমি আনন্দিত হলাম। যেনবা আমার ভেতরেই যেন কোনো কিছুর পুনর্জন্ম হলো।’
মুহাম্মদের চাচি হালা সালেম দীব এখন তাকে লালনপালন করছেন। যুদ্ধের সেই রাত তার জীবনে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওর জন্মের রাতটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন রাতগুলোর একটি। যুদ্ধের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমরা কোনোভাবে শিশুটির জন্ম দিতে সক্ষম হই। শাইমা হাসপাতাল যেতে কাঁদছিল, কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক ছিল আমরা তাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারিনি।’
হালা সালেমের নিজেরও চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি মুহাম্মদের প্রতিদিনের যত্ন নেন। হালা আর তার স্বামী শিশুটির জন্য মা-বাবা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
মুহাম্মদ সুফিয়ান আজও তার মা-বাবাকে ডাকে, ‘আমার আম্মু কোথায়..! আমার আব্বু কোথায়।’ ঘরের কোণে বসে আপনমনে কাঁদে সারাদিন। সে জানে না, এই পৃথিবীতে সে একমাত্র জীবিত সাক্ষী হয়ে রইল তার পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার।
সেই একই দিনে, একই ভয়াবহ গণহত্যা থেকে আরেকটি শিশু বেঁচে যায়। ছয় বছরের মুহাম্মদ সুফিয়ান সালেম। সুফিয়ান পুরো পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ফেলে। মাথায় আঘাত পায়। মনে ভয় আর আতঙ্ক—অমোচনীয় ক্ষতচিহ্ন রেখে যায় তার জীবনজুড়ে। সুফিয়ানের মামা রফিক সালেম বলেন, ‘হঠাৎ চারিদিকে ট্যাংক আর গোলাবর্ষণ। বাড়ির বাইরে গেলেই গুলি চালানো হতো। সেদিন আমি আমার চোখের সামনেই পরিবারকে হারিয়েছি।’
মুহাম্মদ সুফিয়ান আজও তার মা-বাবাকে ডাকে, ‘আমার আম্মু কোথায়..! আমার আব্বু কোথায়।’ ঘরের কোণে বসে আপনমনে কাঁদে সারাদিন। সে জানে না, এই পৃথিবীতে সে একমাত্র জীবিত সাক্ষী হয়ে রইল তার পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার।
মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ সুফিয়ান, এই দুটি শিশুই একটি নিষ্ঠুর ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। তাদের মধ্যে কেউ জানে না পৃথিবী কত নিষ্ঠুর হতে পারে। কেবল তাদের মা-বাবার স্নেহের জন্য হাহাকার করে, ভয়ে কাঁপে, আর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
আতাউল্লাহ আয়মান
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link