নিউজনেস্ট

তুফান আল আকসা: সাফল্য নাকি বিপর্যয়?

তুফান আল-আকসা: সাফল্য নাকি বিপর্যয়?
তুফান আল-আকসা: সাফল্য নাকি বিপর্যয়? ছবি: আল জাজিরা

এক বছর পেরিয়ে গেছে তুফান আল আকসা যুদ্ধের। ইতোমধ্যেই এক বছরের  এই যুদ্ধ আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে একটি পালা বদলের অধ্যায় হিসেবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। একদিকে যেমন ফিলিস্তিনিরা এই যুদ্ধকে স্বাধীনতার পথে একটি মজবুত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে  ইসরায়েল এটিকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এটি এমন এক সংঘাত, যেখানে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

ইসরায়েলের লক্ষ্য এবং প্রতিরোধের অবস্থান

ঐতিহাসিক ৭ই অক্টোবর হামাসের তুফান আল আকসা অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি, গাজার উপর অবরোধের অবসান এবং আল আকসা মসজিদে হামলা বন্ধ করা। কিন্তু পরবর্তীতে সংঘাতটি ধীরে ধীরে অস্তিত্বের লড়াইয়ে রূপ নেয়। একদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরায়েলের অসম শর্ত কখনোই মেনে না নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় দৃঢ় লড়াই চালিয়ে গেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে তাদের কথিত নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

যুদ্ধের সময় ও পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলের নেতারা বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, গাজা যুদ্ধের কয়েকদিন পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ঘোষণা দেন, গাজা সম্পূর্ণ অবরোধে থাকবে। সেখানে খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আগ্রাসনের বৈধতা তৈরি করতে ধর্মকে ব্যবহার করেন। নেতানিয়াহু তাওরাতের পৌত্তলিক আমালেকাদের উল্লেখ করে গাজায় আগ্রাসনের বৈধতা তৈরি করেন।

স্বাভাবিকভাবেই ইসরা‍য়েলি নেতাদের গাজার মানুষের বিরুদ্ধে এই কঠোর মনোভাব আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু ইসরায়েল এসবেরম তোয়াক্কা না করে গাজায় তাদের সামরিক অভিযানের নামে গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে।

পাগল তত্ত্বএবং এর প্রয়োগ

২০০৬ সাল থেকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা কৌশলে দেশটির সাবেক সেনাপ্রধান ড্যান হ্যালুৎসের একটি তত্ত্ব বহুল ব্যবহৃত। তত্ত্বটির নাম পাগল তত্ব। এই তত্ত্বের মানে হচ্ছে, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুকে দেখিয়ে দেওয়া যে ‘বাড়ির মালিক প্রতিশোধে পাগল হয়ে গেছে।’ তুফান আল আকসার যুদ্ধেও এই তত্ত্বের জোরালো প্রয়োগ করেছে ইসরায়েল। ফলে গাজায় এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে যা কল্পনার বাইরে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল মূলত প্রতিরোধ আন্দোলনকে বুঝাতে চেয়েছিল, ইসরায়েল প্রতিশোধ নিতে ধারণাতীত ভয়াবহ আক্রমণ চালাতে পারে।

কিন্তু এই তত্ত্ব গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি;  উল্টো এই তত্ত্ব ইসরায়েলের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। ফলে বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে প্রতিরোধকে চাপ দিতে পারার কোন বিকল্প নেই। কারণ, গাজায় পাগল তত্ত্বের প্রয়োগের পর প্রতিরোধ স্তিমিত না হয়ে দৃঢ় হয়েছে।

ইসরায়েল মনে করেছিল, তারা গাজা থেকে হামাসকে নির্মূল করতে এবং তাদের অসম শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে। কিন্তু ইসরায়েল যেটা ভাবতে পারেনি সেটা হল, যুদ্ধের বিস্তৃতির ফলে অন্যান্যরাও এতে যুক্ত হবে এবং অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এভাবে আগ্রাসন ভবিষ্যতে ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে এটা খোদ ইসরায়েল চিন্তাও করেনি।

এদিকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর যদিও তুলনামূলক শান্ত দেখাচ্ছে; কিন্তু সেখানেও প্রতিরোধ ধীরে ধীরে বাড়ছে। যা এক সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে   ইসরায়েলের জন্য একটি কঠিন ফ্রন্ট তৈরি করবে।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ এবং ইসরায়েলের ব্যর্থতা

গাজায় চলছে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ। ট্যাংক ধ্বংস করা, বিস্ফোরক ফাঁদ পাতা এবং ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালানোসহ বিভিন্ন কৌশলে প্রতিরোধ আন্দোলন ইসরায়েলি বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন করছে।

যুদ্ধের কোন কার্যকর সমাপ্তি দেখতে না পাওয়ায় পদত্যাগ করেছেন অনেক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা। এর মধ্যে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান আহারন হালেভা, গোয়েন্দা ইউনিট-৮২০০ এর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়োসি শ্যারিয়েলের মত কর্মকর্তারাও রয়েছেন। এসব পদত্যাগে যেমন ইসরায়েলি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ও হতাশার প্রতিফলন ঘটেছে; তেমনিভাবে এটাও প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের কৌশলগুলোতে সম্পূর্ণ সফল হয়নি।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল গাদি শামনি তো  স্পষ্ট স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গাজার পরিস্থিতি জটিল এবং কঠিন। যুদ্ধের কোন লক্ষই পূরণ হয়নি। হামাসকে দমন করা যায়নি। বন্দিদের মুক্ত করা যায়নি।’

এ প্রসঙ্গে আমেরিকান মিডিয়া আউটলেট এক্সিওসের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্সিওস বলছে, নেতানিয়াহুর সহকারী যুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও ইসরায়েলি জনগণের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন।

ইসরায়েলের প্রচার কর্তৃপক্ষের এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ ইসরায়েলি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই যুদ্ধে ব্যর্থতা অনুভব করেছে। এছাড়াও ৮৬ শতাংশ ইসরায়েলি জানিয়েছেন, তারা যুদ্ধের পর গাজার আশেপাশে আর বসবাস করতে চান না। যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলি সমাজে তৈরি হয়েছে তীব্র বিভেদ। যুদ্ধের প্রতি মানুষের এই পারষ্পরিক বিরোধপূর্ণ মনোভাব যুদ্ধের সমাপ্তির পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে তৈরি করেছে মতবিরোধ।

এদিকে ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান ‘কান’ দ্বারা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ২৩ শতাংশ ইসরায়েলি উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।

২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে ইসরায়েলি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ৪০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি দেশ ত্যাগ করেছেন। ২০২৩ সালেও প্রায় ৫৫,৩০০ ইসরায়েলি দেশ ত্যাগ করেন। যা ২০২২ সালে দেশত্যাগীদের সংখ্যা থেকে অনেক বেশী। ২০২২ সালে ছিল দেশত্যাগী ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ৩৮,০০০।

এদিকে ইসরায়েলিদের মধ্যে যখন এত ভাঙন এত বিভেদ, তখন অপরদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার এখন হামাস পুনর্গঠনের পরিকল্পনা তৈরি করছেন।

হিজবুল্লাহ ও হুথির সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব

তুফান আল আকসা শুরুর পর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি সীমান্তে হামলা চালায় এবং ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে মানুষকে ঘরছাড়া করে দেয়। ফলে ইসরায়েল বাধ্য হয়ে লেবাননে আরেকটি নতুন সংঘাতে প্রবেশ করে।

অন্যদিকে হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরের বাণিজ্য বন্ধ করে এবং ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করে আসছে। এই আন্তর্জাতিক সহায়তার কারণে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এবং ইসরায়েলের সামরিক অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়ে। আর আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলের উপর ক্রমাগত চাপ তো আছেই।

প্রতিরোধের পুনর্গঠন এবং আত্মনির্ভরশীলতা

ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, হামাস দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিজেরাই তৈরি করছে। দিন বদলানোর সাথে সাথে গাজায় হামাসের প্রতিরোধ প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হয়েছে। যুদ্ধে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং সামরিক কৌশলে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।

এই আত্মনির্ভরশীলতার কারণে হামাস এখনো দীর্ঘদিন প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সাধারণ ফিলিস্তনিদের মধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলন একতা ও সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, গাজার মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং প্রতিরোধের প্রতি তাদের সংহতি অব্যাহত রেখেছে।

ভবিষ্যৎ অবস্থা

তুফান আল আকসা যুদ্ধের পর থেকে ইতোমধ্যেই ইসরায়েল সরকার এবং সেনাবাহিনী ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে। অন্যদিকে তুফান আল আকসা কেন্দ্র করে সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল যেকোনো সময় ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। তবে এখনও অনিশ্চিত এই যুদ্ধের ফলাফল।

এদিকে ইসরায়েল গাজা থেকে হামাসকে নির্মূল করতে চাইলেও যুদ্ধের পরিসর ক্রমেই বাড়ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত ইসরায়েলের ভবিষ্যতের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠছে। অপরদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ শক্তিও ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে। তাদের সংগ্রাম ইসরায়েলের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গাজাবাসীর সমর্থন ও সংকল্প

গাজার জনগণ তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং এই প্রতিরোধে তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এই সংঘাতের শেষ কেবল তখনই হবে, যখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের শর্ত মেনে নেবে বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি হারাবে। এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে কে জয়লাভ করবে সেটা সুনির্দিষ্ট আকারে বলা না গেলেও এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়।

কারণ, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিটিকাল অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন সশস্ত্র প্রতিরোধই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক পথ। জরিপে অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি মনে করেন, ‘প্রতিরোধই দখলদারিত্ব শেষ করার সর্বোত্তম উপায়।’ এছাড়াও পশ্চিম তীর এবং গাজার প্রায় ৭২ শতাংশ জনগণ তুফান আল আকসার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।

সুতরাং এটা বলাই যায়, এই যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। তুফান আল আকসা যুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে: ‘ইসরায়েল যতই ধ্বংসযজ্ঞ চালাক না কেন, প্রতিরোধই তাদের মুক্তির একমাত্র উপায়।’

আতাউল্লাহ আয়মান
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত