ইসরায়েলের ইতিহাসে মাত্র দু’বার এমন হয়েছে, যখন দেশটি অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছিল। দুটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। প্রথমটি ঘটে ১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর। যখন মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে যা ‘অক্টোবর যুদ্ধ’ বা ‘ইয়োম কিপুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় আক্রমণটি ঘটে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর। যখন ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকারী দল হামাস ইসরায়েলে একটি অভূতপূর্ব আক্রমণ চালায়।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশটি সবসময়ই আক্রমণকারী পক্ষ ছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলোর ব্যাপক সমর্থন পেয়ে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতাশীল হিসাবে আবির্ভূত হয়ে একের পর এক আরব ভূমি দখল করে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভীতি সঞ্চার করে। এদিকে আরব দেশগুলো -ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য যাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল- ক্রমাগত পরাজিত হয়েছে। আরব বারবার পরাজিত হলেও কখনো আংশিক সাফল্য পেলে নিজেদের বিজয়ী মনে করত। যদিও সেটা নিজেদের বিজয়ী ভাবা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
নাকাবা, আক্রমণ এবং বারবার পরাজয়
ইসরায়েলের পাকাপাকি প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৯৪৮ সালের মে মাসে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর। যুদ্ধের পর আরব দেশগুলো এই ঘটনাকে ‘নাকাবা’ বা বিপর্যয় বলে অভিহিত করে। কিন্তু এই পরাজয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে আরব দেশগুলো আরেকটি বড় পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয়।
১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এবার ইসরায়েল আগ বেড়ে মিশরে আক্রমণ চালায় এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও এতে যোগ দেয়। তবে এবার সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে এই ত্রিমুখী শক্তিগুলোকে পিছু হটতে হয়।
পরবর্তী পরাজয় আসে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে। ১৯৬৭ সালের সেই সংঘাতকে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ও বলা হয়। ইসরায়েল সেই যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং মাত্র ছয় দিনে তিনটি আরব ভূখণ্ড -গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান মালভূমি- দখল করে নেয়। এই পরাজয় আরবদের জন্য অপমানজনক ছিল এবং আরবরা একে ‘নাকাসা’ বা বড় পরাজয় বলে অভিহিত করে।
অক্টোবর যুদ্ধ: ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম সফল চ্যালেঞ্জ
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে মিশর ও সিরিয়া মিলে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালায়। মিশরীয় সেনাবাহিনী সুয়েজ খাল অতিক্রম করে এবং কৌশলগত এলাকা বারলেভ লাইন ধ্বংস করে। আর সিরিয়া উত্তর দিক থেকে গোলান মালভূমিতে আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ইসরায়েল যদিও সামগ্রিকভাবে পরাজিত হয়নি, তবে আরবরা এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক বিজয় হিসেবে দেখেছিল। কারণ, এই প্রথমবার আরব দেশগুলো ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এক ধরনের প্রতিরোধ সক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল।
তবে ইসরায়েল এই সংঘাতেও ঘুরে দাঁড়ায় এবং আরবদের আক্রমণ প্রতিহত করে। কিন্তু এই আক্রমণে ইসরায়েলের অপরাজেয় হওয়ার ধারণা ভেঙে যায়। এই যুদ্ধের পর ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। যা পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে পরিণত হয়। যদিও অনেক আরব দেশের কাছে এই চুক্তি একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
তুফানুল আকসা: ৫০ বছর পর আরেকটি সফল আক্রমণ
১৯৭৩ সালের ঠিক ৫০ বছর পর। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। যখন ইসরায়েল ধারণা করেছিল যে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, তখনই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি অত্যন্ত পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের নাম দেওয়া হয় ‘তুফানুল আকসা’। এই আক্রমণের প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শত শত ইসরায়েলি নিহত হয় এবং প্রায় দুই শতাধিক বন্দি হয়। এই আক্রমণ ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ব্যাপক।
তুফানুল আকসার সময়, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকারী দলগুলোর কোনো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বা সামরিক বাহিনী ছিল না। তাদের পাশে ছিল না কোনো শক্তিশালী মিত্র দেশ বা আধুনিক অস্ত্রের সমর্থন। বরং তারা স্বল্প সরঞ্জাম এবং নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি এই আক্রমণের পরে কিছু আরব দেশ প্রতিরোধকারী দলগুলোর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে অনিচ্ছুক ছিল। আর কিছু দেশে তো ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মিছিলও নিষিদ্ধ করা হয়।
প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
৫০ বছর পর তুফানুল আকসা অপারেশনে আবারও প্রমাণিত হয় ইসরায়েল অজেয় নয়। যদিও ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন অনেক বেশি, তবে প্রতিরোধকারী দলগুলো যে ইচ্ছাশক্তি ও ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে ইসরায়েলের মুখোমুখি হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। অন্যদিকে এই অপারেশনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুর প্রতি আরব দেশগুলোর অবস্থানকে পুনরায় যাচাই করার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
ফিলিস্তিনিদের জন্য সমর্থন ও সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবতা হলো, বর্তমান আরব নেতৃত্বের অনেকেই ফিলিস্তিন ইস্যুকে তাদের প্রধান এজেন্ডায় রাখেনি।
মোটকথা, ইসরায়েলের অজেয় হওয়ার ধারণা ৭ই অক্টোবর পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এবং এই আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবেশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে এবং প্রমাণ করেছে যে, প্রতিরোধই শেষ কথা নয়। বরং স্থায়ী সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ, সমর্থন এবং সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজন।
সূত্র: আল জাজিরা