ভারতের সামরিক উদ্ভাবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। যখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বেঙ্গালুরুর হিন্দুস্তান এয়ারক্রাফট কারখানা পরিদর্শন করেন। সেখানে বিখ্যাত জার্মান প্রকৌশলী ‘কুর্ট ট্যাংক’ তার নেতৃত্বে তৈরি ‘মারুত’ জেট যুদ্ধবিমান প্রদর্শন করেন। কিন্তু বিমানের পূর্ণাঙ্গ ইঞ্জিন তৈরির ক্ষমতা তখনও অর্জন করতে পারেনি ভারত। ফলে সে সময় ভারতকে মারুত বিমানের জন্য ব্রিটিশদের তৈরি ‘অরফিউস’ ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হয়েছিল, যা ‘মারুত’ বিমানটিকে সুপারসনিক গতি দিতে পারেনি। যুদ্ধবিমান উৎপাদনের এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

চীনের আক্রমণ এবং সামরিক বন্ধুত্বের সন্ধানে ভারত

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলে বড় পরিবর্তন আনে। চীনের কাছে পরাজয়ের পরে ভারত চীনের মোকাবেলায় সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা চায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভারত মিগ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করে এবং ক্রমশ একটি কৌশলগত সামরিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলে। ভারত তার স্বাধীনতার পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেও, চীনের হুমকির মুখে আমেরিকা, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করে। ষাটের দশক থেকে ভারত সামরিক আমদানির মাধ্যমেই প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়াতে থাকে।

সামরিক নীতি সম্পর্কের বিবর্তন

ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গুলি এবং ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী যশবন্ত সিংহার মতে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তিনটি ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে। নেহেরুর অধীনে প্রথম ধাপ ছিল আদর্শবাদী। দ্বিতীয় ধাপে ছিল আত্মনির্ভরতা নীতি। আর বর্তমানে তৃতীয় ধাপ; তথা স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করা হয়। সামরিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি এবং চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৌশল হিসাবে ভারত সামরিক সরঞ্জাম আমদানি ও বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে।

সামরিক আমদানি বাজারের রাজনীতি

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩। এই সময়টুকুতে বৈশ্বিক সামরিক আমদানির ৯.৮ শতাংশ আমদানি করে ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আমেরিকা, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সাথে প্রতিরক্ষা ক্রয়ে সম্পর্ক দৃঢ় করে ভারত। তবে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারত বিকল্প সরবরাহকারী দেশগুলোর সাথে চুক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে।

মে ইন ইন্ডিয়া

২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার লক্ষ্য ছিল ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে স্বনির্ভর করা। এই উদ্যোগের অধীনে দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রসারে জোর দেয়া হয়। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির সাথে যৌথভাবে ‘এফ-৪১৪’ জেট ইঞ্জিন উৎপাদন শুরু করে, যা ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ‘তেজস’ যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত হয়।

অস্ত্র রপ্তানিতে ভারতের অগ্রগতি

ভারতের লক্ষ্য শুধুমাত্র স্থানীয় চাহিদা মেটানো নয়। বৈশ্বিক অস্ত্র বাজারে প্রবেশ করাও ভারতের লক্ষ্য। ২০২৩ সালে ভারত ১.৯৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করে। বর্তমানে ভারতীয় কোম্পানিগুলো প্রায় ৮৫টি দেশে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। ভারতের তৈরি ‘তেজস’ যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ বাড়ছে।

প্রতিকূলতা সীমাবদ্ধতা

অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে সাফল্যের পথে ভারতকে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গবেষণাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বেশিরভাগ রপ্তানি হালকা সামরিক সরঞ্জামে সীমাবদ্ধ। তাই টেকসই রপ্তানি উন্নয়নের জন্য ভারতকে ভারী সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও রপ্তানির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাবে ভারতের স্বনির্ভর সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।

ভারত এখন বিশ্ব সামরিক বাজারে একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান অর্জন করার প্রচেষ্টায় আছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ ও বিভিন্ন কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভারত অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে চায়। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তি ও অবকাঠামোতে ভারতের এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। তাই বৈশ্বিক অস্ত্র বাজারে প্রবেশ করা ভারতের জন্য এখনো একটি চ্যলেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *