নিউজনেস্ট

জায়তুনের মৌসুম: আরবের উৎসবমুখর গ্রামীণ সমাজের নানা চিত্র

ঐতিহ্যবাহী জায়তুন মৌসুম: আরবের উৎসবমুখর গ্রামীণ সমাজের নানা চিত্র
ঐতিহ্যবাহী জায়তুন মৌসুম: আরবের উৎসবমুখর গ্রামীণ সমাজের নানা চিত্র। ছবি: তানবিন

আবহমান কাল ধরে আরবের গ্রামীন জীবনে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসা মৌসুমের নাম জায়তুন মৌসুম। অক্টোবরের শুরুতে যখন ভোরের আলো ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন আরব দেশের গ্রামাঞ্চলে তখন শুরু হয় জায়তুন সংগ্রহের প্রস্তুতি। পরিবারে পরিবারে তৈরি হয় নানা স্বাদের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার।

সকালের প্রথম প্রহরে আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে গ্রামের সবাই যাত্রা করে সবুজ জায়তুন বাগানের দিকে। জায়তুন মৌসুমের সন্ধ্যাগুলো শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। গ্রামের লোকেরা প্রতিবেশী আর বন্ধুদের সাথে মিলিত হয়ে মেতে ওঠে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যে। সাথে গাওয়া হয় শত বছর ধরে মুখে মুখে চলে আসা জায়তুন মৌসুমের গান। মশাল জ্বেলে রাতভর তরুণ কিশোরের মধ্যে চলে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। এক কথায় আরবে জায়তুন মৌসুম মানেই আরবের গ্রামাঞ্চলে উৎসবের মহাসমারোহ। 

যেভাবে সংগ্রহ করা হয় ঐতিহ্যবাহী জায়তুন

জায়তুন সংগ্রহে আরবের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী পুরুষ এবং মহিলারা একত্রিত হয়ে কাজ ভাগ করে নেন। মাটিতে প্রথমে প্লাস্টিক ম্যাট বা কাপড়ের চাদর বিছানো হয়। এরপর গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে অথবা গাছের নিচে হাত দিয়ে সংগ্রহ করা হয় আরবের ঐতিহ্যের পুরো অংশে ছড়িয়ে থাকা ফল জায়তুন। গাছের ওপরের অংশের জায়তুন সতর্কতার সাথে সংগ্রহ করা হয়, যাতে গাছের কোনো ক্ষতি না হয়। এরপর মাটিতে পড়ে থাকা কম মানের জায়তুনগুলো সাবান তৈরির জন্য আলাদা করা হয়।

সবুজ জায়তুন নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত সংরক্ষণের জন্য সংগ্রহ করা হয়। আর শীতের শুরুতে কালো জায়তুন লবণ মেখে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর জায়তুনগুলো ঐতিহ্যবাহী পাথরের মিলে নিয়ে গিয়ে বিশুদ্ধ জায়তুন তেল তৈরির কাজ করা হয়। যা এখনো স্থানীয়রা তাদের পছন্দের তালিকায় পরম যত্নে রেখে দেন।

জায়তুনমৌসুমে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য

লেবানন: জায়তুন মৌসুমে ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী এই দেশটির গ্রামবাসীরা আলোকিত মশাল নিয়ে একত্রিত হয় এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। কারণ, বৃষ্টি জায়তুন গাছকে সতেজ করে। ফলে জায়তুন বৃক্ষ বেড়ে ওঠে এবং জায়তুন তেলের গুণমান বাড়ায়। এ সময়ে স্থানীয়রা সার্ডিন, রুটি, সবজি এবং মাটির জগে পানীয় নিয়ে আসে।

তিউনিসিয়া: জায়তুন মৌসুমকে ঘিরে দেশটির গ্রামাঞ্চলে বিশেষ এক ধরনের রুটি তৈরি করা হয়, যা নতুন জায়তুন তেলের সাথে খাওয়া হয়। এছাড়া কুসকুস, মসলাযুক্ত খাবার এবং আসিদার মতো অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবারও প্রস্তুত করা হয়, যা জায়তুন মৌসুমে স্থানীয় খাবারের তালিকায় বৈচিত্র্য আনে।

ফিলিস্তিন: জায়তুন মৌসুম শুরু হলে ফিলিস্তিনের পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করে। বিভিন্ন ধাঁচের গান, কৌতুক এবং ধাঁধা সমাধানের মধ্য দিয়ে অন্যরকম বিনোদন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় দেশটির ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন: আঙ্গুর পাতা, মাকলুবা এবং জায়তুন তেলে ডোবানো মসাখান রান্না করা হয়। এ সময় সাধারণ চুলা বাদ দিয়ে ব্যবহার করা হয় পাথরের চুলা। শুষ্ক জায়তুন শাখা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে এসব খাবার তৈরি করা হয়। যার প্রতিটিই ফিলিস্তিনের শত বছরের ঐতিহ্যের প্রতিফলন।

সিরিয়া: সিরিয়ার জায়তুন মৌসুমে সকালবেলা স্থানীয় খাদ্য যেমন: থাইম, পনির, মাখন এবং ফলমূল পরিবেশন করা হয়। দুপুরের খাবারে বুলগুরের সাথে মসুর ডাল বা ছোলা এবং মাকলুবা পরিবেশন করা হয়। পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যের জনপ্রিয় গান আর উচ্ছল আলাপ তো আছেই।

মোটকথা, জায়তুন মৌসুম যেন দেশভেদে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জীবনের স্পন্দনকে একত্রিত করে। এই সময়ে মানুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়। শতাব্দীব্যাপী চলে আসা ঐতিহ্যবাহী উৎসবে মেতে ওঠে। সেই সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জায়তুনকে কেন্দ্র করে তাদের সংস্কৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখে।

আতাউল্লাহ আয়মান
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত