ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যকার চলমান উষ্ণ সম্পর্ক অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কারণ এই উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এমন এক সময়ে যখন ভারতে ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী জনতা পার্টি (বিজেপি)। আদর্শের প্রশ্নে বিজেপি এবং তালেবানের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অনেকটাই নমনীয় মনোভাব পোষণ করছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
কিন্তু এই পরিবেশই কিভাবে তৈরি হল এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এমনিতে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে কাবুলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করে এসেছে। এই সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং আরও দৃঢ় করতে, ১৯৫০ সালে ভারত-আফগান বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।
ভারত সবসময়েই আফগানিস্তানকে একটি কৌশলগত সহযোগী রাস্ট্র হিসেবে দেখেছে। বিভিন্ন শাসনামলে, যেমন রাজতান্ত্রিক শাসন, প্রজাতন্ত্রীয় শাসন, মস্কোর অধীনস্থ কমিউনিস্ট শাসন এবং তালেবান পরবর্তী হামীদ কারজাই ও আশরাফ গনির শাসনকালেও ভারত আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ভারত আফগানিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে।
তালেবানকে একটি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়া
তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে ভারত উপলব্ধি করে তালেবান আফগানিস্তানের একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন নতুন করে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেয় ভারত। প্রথমে এই সম্পর্ক শুধুমাত্র মানবিক সাহায্য এবং ত্রাণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে পরবর্তীতে ভারত নতুন সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করে।
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। ২০২২ সালের জুন মাসে ভারপ্রাপ্ত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জে.পি. সিং-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বৈঠকে আফগানিস্তানে ভারতের স্থগিত প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করার জন্য তালেবান কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানিয়েছে।
এদিকে তালেবানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের সাবেক মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আফগান শিক্ষামন্ত্রী মির ওয়াইস বলখি ভারতের নীতির সমালোচনা করে বলেন, এটি তালেবান শাসনকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদ বৃদ্ধি করতে পারে।
প্রসঙ্গ যখন কাশ্মীর ইস্যু
কাশ্মীর ইস্যুটি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে অবস্থিত এবং সেখানে পাকিস্তান সমর্থিত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। ভারত আতঙ্কিত ছিল তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে এই গোষ্ঠীগুলি আরও শক্তিশালী হতে পারে এবং তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে তালেবান ভারতের কাশ্মীর ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য প্রদান করেনি এবং জানিয়েছে তালেবান ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
ভারত মনে করছে তালেবান সরকারের সাথে কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্ভব। ভারত তালেবানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কৌশলগতভাবে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগ্রহী।
মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যের বিকল্প পথ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যের জন্য বিকল্প পথ খুঁজছে। আফগানিস্তান হয়ে ইরানের চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে ভারত এমন একটি পথ পেয়েছে, যা আফগানিস্তানের জন্যও অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে। এই বন্দরের মাধ্যমে আফগানিস্তান ভারতের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীরতর করতে পারে। তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদও একে সমর্থন জানিয়ে বলেন আফগানিস্তান-ইরান রেলপথ চালু হলে আফগানিস্তানের ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান নির্ভরতা কমিয়ে তাদের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চালাতে পারবে।
ভারত আফগানিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চায়। ইতিমধ্যেই ভারত তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে স্বাধীনভাবে কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই ধরেই নেয়া যায় এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার অনেকটা কৌশলগত প্রভাব এবং শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে।
তবে ভারত ও আফগানিস্তানের এই সম্পর্কের পুনর্গঠন একটি কৌশলগত বাস্তবতামাত্র । বিশেষত, আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন তাদের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক না রেখেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে তালেবান ভারত সরকারের অতি প্রয়োজনীয় মিত্র। কারণ আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ভারতীয় জাতীয় স্বার্থে উপকারী হতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link