দেশের শীর্ষস্থানীয় কওমি মাদরাসা জামিয়া আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর তত্ত্বাবধানে ‘রাবেতাতুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়্যাহ আল মারকাজিয়্যাহ বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন শিক্ষাবোর্ড গঠন করা হয়েছে।
গতকাল ২৭শে অক্টোবর, রবিবার, সকাল ১০টায় হাটহাজারী মাদরাসা মিলনায়তনে উক্ত বোর্ডের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সর্বসম্মিতক্রমে ‘রাবেতাতুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়্যাহ আল-মারকাজিয়্যাহ’ বোর্ড গঠন এবং এর কমিটি অনুমোদন করা হয়।
হাটহাজারী মাদরাসার পক্ষে থেকে এ ব্যাপারে এক অফিশিয়াল বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘হাটহাজারী মাদরাসা দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ দ্বীনী দরসগাহ, মাকবুল এদারা এবং বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস। হাটহাজারী মাদরাসার লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ভক্ত দেশ-বিদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং বিভিন্নভাবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। হাটহাজারী মাদরাসার সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ, অবহেলা, অবজ্ঞা কোনোভাবে কাম্য নয়। হাটহাজারী মাদরাসার তত্ত্বাবধানে ‘রাবেতাতুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়্যাহ আল মারকাযিয়্যাহ বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন বোর্ডের যাত্রা আজ শুরু হয়েছে।’
কিন্তু দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিস থেকে আলাদা হয়ে নতুন করে বোর্ড ঘোষণা করার পর কওমি মাদরাসার চিন্তাশীল শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
শিক্ষার্থীদের একপক্ষ অভিযোগ করেছেন বেফাকের অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে। তারা বলছেন, বেফাকে খাস কমিটির নামে আলাদা সিন্ডিকেট আছে। নানান অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় স্বতন্ত্র বোর্ড হিসেবে বেফাক প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বারবার। এই কারণেই বেফাকের মাঝে বিভক্তি দেখা দিচ্ছে।
আরেকপক্ষ বলছেন এখন ঐক্যের সময়, ঐক্যবদ্ধতার কাতারে না থেকে হাটহাজারীর এমন সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ করেছে অনেককে। তারা অভিযোগ করছেন হাটহাজারি কর্তৃপক্ষ পদের মোহে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আবার এদিকে হাটহাজারীর মতো দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে বেফাকের খাস কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে অবহেলিত এবং গৌণ রাখার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।
নেটিজেনদের মধ্যে একপক্ষ ক্ষোভের সুরে সংস্কারের আবেদনও করেছেন। সাদিক ফারহান নামে একজন তরুণ কওমি চিন্তক বলছেন, ‘দুই যুগ ধরে বেফাকের সংস্কার চাওয়া হচ্ছে। বোর্ড হিসেবে এক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়া বেফাক সেভাবে বিস্তৃতই হতে পারেনি। না হলো যুগোপযোগী সিলেবাস, না জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়, না সনদের যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা। কষ্ট করে মুমতাজ-স্ট্যান্ড করেও সামান্য মূল্য নেই। এলাকার মসজিদে ইন্টারভিউ হলে আলিয়ার কাগজ নেই বলে মূল্য পায় না কওমির ছাত্ররা। দেশে হাদিসে তাখাসসুস (ডিগ্রী) করেও বিদেশে প্রাণের রিস্ক নিয়ে গিয়ে সানুবিয়া পড়তে হয় সংস্কারের কারণে। কতটা ভঙ্গুর, কতটা মূল্যহীন, কতটা নিম্নতর শিক্ষাব্যবস্থা হলে এই বেহাল দশা হয়! সিলেবাসের যৌক্তিক সংস্কার না করায় মাদানি নেসাবের উৎপত্তি হলো। প্রতিটা মাদরাসা নিজস্ব সিলেবাসে চলে। যার যেভাবে ভালো লাগে, সেভাবে। শিক্ষাবোর্ডগুলোর গুরুত্ব শুধু বোর্ডপরীক্ষার জামাতগুলোতে। যদি সনদের ব্যাপার না থাকত, তাহলে সেখানেও মূল্যহীন থাকতো ছাত্ররা।’
তিনি আরও বলেন, ‘কওমির হাজার হাজার ছাত্র গোপনে জীবনের রিস্ক নিয়ে দেওবন্দ যায়। মিশরে লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটায়। বিদেশে উচ্চশিক্ষার আশায় দুয়েক জামাত গ্যাপ দিয়ে আলিয়ার কাগজের জন্য দৌড়ঝাঁপ করে। তাদের জন্য কিছু করা উচিত। প্রতি বছর দেশের কওমি কর্ণধাররা দেওবন্দে যান, ছাত্রদের নসিহত করেন, তাদের অভিযোগ শোনেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। যদি এখনো নিজেদের সংস্কার, কাগজ পত্রের পরিস্থিতি ও জাতীয় পর্যায়ে কার্যকরী স্বীকৃতি আদায় না করা হয়, তাহলে কওমির ছেলেরা আলিয়ামুখী হবে। নতুন নতুন বোর্ড দাঁড়াবে। এবং সমন্বিত সিলেবাসের কারণে বিরোধ বাড়বে এবং পুরো কওমি অঙ্গন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছেলেরা দিনদিন কওমিবিমুখ হবে।’