জর্জ ইবরাহিম আবদুল্লাহ। একজন লেবানিজ যোদ্ধা, যিনি শুধু নিজের জন্মভূমি লেবানন নয়, ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন। তবুও তিনি আজও ফ্রান্সের কারাগারে চার দেয়ালে বন্দি। তার সংগ্রামের গল্পটি একদিকে যেমন দুঃখজনক, অন্যদিকে তা সাহস ও দৃঢ়তার প্রতীক।
রাজনীতির জগতে এক কিশোরের প্রথম পদক্ষেপ
১৯৫১ সালের ২রা এপ্রিল, লেবাননের আক্কার জেলার ছোট্ট গ্রাম কুবাইয়াতে জন্ম জর্জ আবদুল্লাহর। তিনি খ্রিস্টান মারোনাইট পরিবারে বড় হন। তার বাবা ছিলেন লেবাননের সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। ছোটবেলা থেকেই জর্জ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিরিয়ান সোশ্যাল ন্যাশনালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি, যা ছিল জর্জ আবদুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা।
একজন শিক্ষক থেকে বিপ্লবী যোদ্ধা
জর্জ শিক্ষাজীবন শেষ করে বৈরুতের আশরাফিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠদান করলেও তার মন ছিল আরো বৃহৎ কিছু নিয়ে। সত্তরের দশকের অস্থির সময়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি হওয়া অন্যায় তার মনকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের মানুষের কষ্ট আর দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন।
গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি লেবানন ন্যাশনাল মুভমেন্টে যোগ দেন এবং নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন- ‘ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই তার নৈতিক দায়িত্ব’।
পপুলার ফ্রন্টের পথে অগ্রযাত্রা
আশির দশকে জর্জ আবদুল্লাহ যোগ দেন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন নামে একটি বামপন্থী আন্দোলনে। তিনি শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং সক্রিয় হয়ে উঠলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে। ১৯৮০ সালে জর্জ এবং তার সহযোগীরা প্রতিষ্ঠা করেন লেবানিজ রেভোলিউশনারি ফ্যাকশনস, একটি মার্কসবাদী সংগঠন যা ফিলিস্তিনের মুক্তির পক্ষে অস্ত্র তুলে নেয়।
বিদেশের মাটিতে সশস্ত্র আন্দোলন
১৯৮১ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে সংগঠনটি ইউরোপজুড়ে পাঁচটি আক্রমণের দায়িত্ব নেয়। ফ্রান্সে আমেরিকান সামরিক উপদেষ্টা চার্লস রে এবং প্যারিসে ইসরায়েলি দূতাবাসের উপদেষ্টা ইয়াকুব বার্সিমানতোভ হত্যার পেছনেও তাদের নাম আসে।
একটি কালো দিন: গ্রেপ্তার এবং কারাবাস
১৯৮৪ সালে ফরাসি পুলিশ তাকে ফ্রান্সের লিয়নে একটি জাল আলজেরীয় পাসপোর্টসহ গ্রেপ্তার করে। প্রথমে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অভিযোগ ছিল, জর্জ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন।
তার দল এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ফরাসি কূটনীতিক সিডনি গিলস পেরোল-কে অপহরণ করে। ফ্রান্স বন্দি বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করেনি।
মুক্তির অপেক্ষায় এক সংগ্রামী বৃদ্ধ
১৯৯৯ সালে ফরাসি আইন অনুযায়ী শর্তাধীন মুক্তির জন্য তিনি যোগ্যতা অর্জন করলেও, রাজনৈতিক কারণে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ফ্রান্সের প্রশাসন আশঙ্কা করেছিল, তার মুক্তি লেবাননে একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।
লেবাননের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও জনগণের দাবী
লেবাননের বিভিন্ন সরকার বারবার তার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছে। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী নজীব মিকাতি ফ্রান্স সফর করে তাকে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ আখ্যা দেন। ২০১৩ সালে ফরাসি আদালত তার মুক্তি অনুমোদন করলেও প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়নি।
বৈরুতে ফরাসি দূতাবাসের সামনে জর্জ আবদুল্লাহর মুক্তির দাবিতে অসংখ্য বিক্ষোভ হয়েছে। তার সমর্থকরা তাকে ফিলিস্তিনের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেখেন।
জর্জের নিজের বক্তব্য
তার সংগ্রাম এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তার এক মন্তব্যেই প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি একজন যোদ্ধা, অপরাধী নই। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের যে লঙ্ঘন হয়েছে, সেটাই আমাকে এই পথে চালিত করেছে।’
জর্জ আবদুল্লাহ কেবল একজন সংগ্রামী ব্যক্তি নন; তিনি ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তার জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রত্যয়ী থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য একটি বার্তা।
একটি প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত— এই সংগ্রামী বৃদ্ধ কি কখনও স্বাধীনতার আলো দেখবেন? নাকি তিনি ইতিহাসের পাতায় চিরকাল বন্দি থেকে যাবেন?
সূত্র: আল জাজিরা