ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা পঁইত্রিশ। মসজিদের ভেতরে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে। যেন একধরনের গভীর প্রতীক্ষার সুর। হঠাৎ করেই দরজার দিকে একচিলতে নড়াচড়া দেখা গেল। চারপাশে এক মুহূর্তের জন্যও যেন নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। কয়েকজন সারিবদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে মিম্বারের দিকে এগিয়ে এলেন। খতীব সাহেব উঠে বসলেন মিম্বারে, চোখে শান্তি আর মুখে সৌজন্যের আভা। সবার প্রতি সালাম জানিয়ে বললেন, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ……
‘আলহামদুলিল্লাহ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য এবং দরুদ ও সালাম প্রেরিত হোক তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। হুজুর তাঁর বয়ানের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং তিলাওয়াত করেন সূরা বাকারাহর দুটি আয়াত—
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم. بسم الله الرحمن الرحيم. الم. ذَٰلِكَ ٱلْكِتَـٰبُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًۭى لِّلْمُتَّقِينَ
তরজমা: “আলিফ-লাম-মীম। এটি সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত।” এরপরে মুসল্লীদের উদ্দেশ্য মুহতারাম বলেন, “আল্লাহ তাআলার বড় মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের পবিত্র জুমার নামাজ আল্লাহর ঘর মসজিদে এসে আদায় করার তৌফিক দান করেছেন। এই কারণে সবাই বলি, আলহামদুলিল্লাহ।”
পূর্বের জুমাগুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে তাকওয়া এবং মুত্তাকীদের সম্পর্কে আলোচনার সূত্র ধরে খতীব সাহেব বলেন, “কোরআনুল কারীমের আলোকে তাকওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। এটা ছাড়া ঈমান পূর্ণ হয় না। প্রত্যেক নবী তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন। নবীদের দাওয়াতের মূল কথা ছিল—
১. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর।
২. তাকওয়া অবলম্বন কর।
৩. নবীর আনুগত্য কর।
আল্লাহ একমাত্র মাবুদ। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। নবীরা দুইভাবে এই দাওয়াত দিয়েছেন। প্রথমত, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না। দ্বিতীয়ত, আল্লাহকে ভয় করো।” তিনি আরও বলেন, “নবীদের দাওয়াতের মূল লক্ষ্য ছিল এই তিনটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর, তাকওয়া অবলম্বন কর এবং নবীর আনুগত্য কর।”
এরপরে খতীব সাহেব সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন: “خاتم النبيين” অর্থাৎ, “তিনি সর্বশেষ নবী। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। যদিও সব নবী শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবীকে সকল নবীর ইমাম বানিয়েছেন। সর্বশেষ নবীকে প্রথম নবীর ইমাম বানিয়েছেন। তাঁকে সাইয়েদুল মুরসালিন (পয়গম্বরদের নেতা) বানিয়েছেন।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “নবীর আনুগত্য, আল্লাহর ইবাদত এবং তাকওয়া—এই তিনটি বিষয়ই ঈমানের মূল ভিত্তি। কোরআন কারীমের প্রথম সূরা ফাতিহার পরে সূরা বাকারা শুরু হয় এই ঘোষণার মাধ্যমে:
“ذَٰلِكَ ٱلْكِتَـٰبُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًۭى لِّلْمُتَّقِينَ”
(সূরা বাকারা, আয়াত ২)
এই কোরআন এমন এক গ্রন্থ, যাতে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। এটি আল্লাহর কালাম, যা কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এটি সম্পূর্ণ হেদায়েত। কিন্তু এটি কেবল মুত্তাকীদের জন্যই পথপ্রদর্শক।”
এরপরে তাকওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে মুহতারাম বলেন, “যার মধ্যে তাকওয়া নেই, সে কোরআন থেকে উপকৃত হতে পারবে না। যার মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই, আখিরাতে বিশ্বাস নেই, সে কীভাবে হেদায়েত গ্রহণ করবে? কোরআন হলো হেদায়েত। অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে চাইলে কোরআনের পথে আসতে হবে। আলোকিত মানুষ হতে চাইলে কোরআন শিখতে হবে। আলোকিত জীবন গড়তে হলে তাকওয়া অর্জন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “তাকওয়া কাকে বলে? তাকওয়ার সুরত কেমন হয়? এটা বুঝতে হলে কোরআনের দারস্থ হতে হবে। ‘هُدًى لِلْمُتَّقِينَ’—এই কোরআন মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত।”
এই আলোচনার পরে মুহতারাম বলেন, ‘ঈমান কাকে বলে, ইসলাম কাকে বলে— এসব নিয়ে আমাদের ফিকির কম।’ স্রেফ কালিমায়ে তাইয়্যিবাহ মূলত কেমন এবং ঈমানের গভীরতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে খতীব সাহেব সূরা ইব্রাহিম থেকে উদ্ধৃতি দেন—
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ
[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ২৪]
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “কালেমায়ে তাইয়েবা পবিত্র গাছের মতো। যখন একজন মুমিন কালেমা পাঠ করে এবং অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে, তখন সে তার অন্তরের জমিনে একটি গাছ রোপণ করে। এই গাছ যত্ন নিতে হয়, হেফাজত করতে হয়, পানি দিতে হয়। ঈমানের এই গাছ যত বড় হয়, তত মজবুত হয় এবং ডালপালা প্রসারিত হয়। এর ফল হলো নেক আমল, যা মানুষকে গোনাহ থেকে বাঁচায় এবং ফিতনা-ফাসাদ থেকে দূরে রাখে।”
এরপরে তিনি ঈমানের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন,
آمنت بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر والقدر خيره وشره من الله تعالى والبعث بعد الموت
( অর্থ: আমি ঈমান এনেছি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, আখিরাতের দিন, তাকদিরের ভালো-মন্দ এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি)।
এরপরে খতীব সাহেব ঈমানের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “এই আকিদাগুলো আমাদের জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আকিদার বিপরীত কোনো কাজ করলে ঈমান থাকবে না। তাই তাকওয়া অবলম্বন করলেই সঠিক ঈমান বজায় রাখা সহজ হবে।” বয়ানের এই অংশে তিনি তাকওয়া, নবীর আনুগত্য এবং কোরআনের হেদায়েতের গুরুত্ব গভীরভাবে তুলে ধরেন।
খতীব সাহেব বলেন,
১. “ঈমানের প্রথম কথা হল, لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ অর্থাৎ, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ এই কালেমার প্রথম দিকেই ঘোষণা করা হয়েছে, শিরক থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সমস্ত ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের শিখিয়েছেন:
‘إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ’ [সূরা ফাতিহা, আয়াত ৫]
অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ, আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।
’তিনি বলেন, ‘প্রার্থনা করতে হলে তা একমাত্র আল্লাহ তাআলার দরবারেই করতে হবে। সেজদা একমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই করতে হবে। কোনো সৃষ্টি, প্রতীক বা অন্য কিছুর প্রতি সেজদা করা বা প্রার্থনা করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত, যা ঈমানকে ধ্বংস করে।’
২. ঈমানের দ্বিতীয় কথা হল, ‘مُحَمَّدٌ رَسُولُ ٱللَّهِ’ অর্থাৎ, মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। রাসূল ﷺ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন এক শরীয়ত দান করেছেন, যার অনুসরণেই রয়েছে মুক্তি ও সফলতা।’
হুজুর সুরাতুল জাসিয়ার ১৮-২০ নং আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন:
‘ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِّنَ ٱلْأَمْرِ فَٱتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ’ إِنَّهُمْ لَن يُغْنُوا عَنكَ مِنَ ٱللَّهِ شَيْـًۭٔا ۚ وَإِنَّ ٱلظَّـٰلِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۢ ۚ وَٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلْمُتَّقِين.
আয়াতের সাবলীল তরজমা ও ব্যাখ্যায় খতীব সাহপব বলেন, ‘হে নবী, আমি আপনাকে দীনের একটি শরীয়ত দান করেছি। আল্লাহর দীন—
ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلْإِسْلَٰمَ دِينًاۚ
আল্লাহর দীন আল্লাহর বান্দার দের জন্য যে দীন পছন্দ করেন, সেটা হচ্ছে ইসলাম।
মুহতারাম বলেন, ‘দীনের জন্য একটা শরীয়ত লাগবে। শরীয়তবিহীন দীন, এটা দীন না। দীন মানে, শরীয়ত মানে না— এটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না। যে দীন আল্লাহ বান্দাদের জন্য পছন্দ করেছেন সেটা হল ইসলাম। ইসলামের একটা শরীয়ত থাকবেই। সেই কথাই আল্লাহ বলেছেন যে ইসলামের একটি শরীয়ত আপনাকে দান করেছি, শরীয়তের উপর আপনাকে আমি প্রতিষ্ঠিত করেছি, যে শরীয়তের উপর আপনাকে রেখেছি তার অনুসরণ করেন। নবীকে আল্লাহ বলেছেন এই শরীয়ত মেনে চলেন। তাহলে নবীর উম্মতেরা এর শরীয়ত মেনে চলতে হবে কি না?’
এরপর মুহতারাম তেলাওয়াত করেন সূরা জাসিয়াহর ১৮ নাম্বার আয়াত—ثُمَّ جَعَلْنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِّنَ ٱلْأَمْرِ فَٱتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
আয়াতের সাবলীল তরজমা এবং ব্যাখ্যায় বলেন, ‘যাদের কাছে ওহীর ইলম নাই, তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না। এটা হল তাকওয়া, এটা হল ঈমান, ইসলাম। ইসলাম সকলের জন্য দীন। দীন বলতেছে আমাদের শরীয়ত লাগবে; ইসলামের শরীয়ত আপনাকে দান করলাম এই কুরআনের মাধ্যমে, হাদিসের মাধ্যমে। হে নবী! আপনার সুন্নত, আপনার জীবন— এটাই উম্মতের জন্য হাদীস।’ এবিষয়ে মুহতারাম দলীল হিসেবে এই আয়াত পাঠ করেন,
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ ٱللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُوا۟ ٱللَّهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلأخِرَ
‘আখেরাতের প্রতি ঈমান আছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আছে, আল্লাহর রহমত চাও, আখেরাতে শান্তি চাও, তাহলে রাসূলুল্লাহর জীবনাদর্শ তোমার জন্য অবলম্বন। এটাকে গ্রহণ করো। এই সুন্নত এবং শরীয়ত এটার মধ্যেই মুক্তি। এটার মধ্যেই সফলতা।’
মুহতারাম আরও বলেন, ‘যাদের কাছে ওহীর জ্ঞান নাই তাদের খেয়ালখুশির, তারা যা বলবে, তারা যে নির্দেশনা দিবে— ওইভাবে মুসলমান চলবে, আল্লাহর মুসলিম বান্দারা ওইভাবে চলবে— এটা আল্লাহ চান না। এভাবে চললে তারা সফলতা পাবে না, শান্তি পাবে না, মুক্তি পাবে না।’
এরপরে খতির সাহেব তেলাওয়াত করেন—إِنَّهُمْ لَن يُغْنُوا۟ عَنكَ مِنَ ٱللَّهِ شَيْئًاۚতরজমা: আল্লাহর বিপরীতে তারা তোমার কিছুমাত্র কাজে আসবে না।
এই আয়াতটিকে বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে মুহতারাম ব্যাখ্যা করেন,
‘যাদের কাছে ওহীর ইলম নাই তারা আমাদের রাহাবার হতে চাই আমাদেরকে রাহাবারি করতে চায়। দেখেন না পশ্চিমা বিশ্ব এখন পুরা দেশের নেতৃত্ব দিতে চাই কিনা চায় পুরা বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায় সব মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতে চায় তারা আল্লাহ বলে দিয়েছেন, إِنَّهُمْ لَن يُغْنُوا۟ عَنكَ مِنَ ٱللَّهِ شَيْئًاۚ (আল্লাহর বিপরীতে তারা তোমার কিছুমাত্র কাজে আসবে না।) ‘কবরে, হাশরে এরা তোমাদের কাজে আসবে না। দুনিয়াতেও কাজে আসবে না।’ হযরত বিষয়টাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেন যে, অনেকে মনে করে এভাবেফায়দা আসবে। কিন্তু কোন ফায়দা আসবে না।
এরপরে পশ্চিমাদের মুখোশ উন্মোচনে মুহতারাম আয়াত পাঠ করেন— وَإِنَّ ٱلظَّٰلِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۖ
তরজমা: যালেমরা একে অপরের বন্ধু।
আয়তের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খতীব সাহেব বলেন, ‘অত্যা*চারীরা একে অপরের বন্ধু। الكفر ملة واحدة অর্থাৎ মুশরিক এবং কাফের যত অমুসলিম; ঘুরেফিরে তারা এক।’
এরপরে খতীব সাহেব আরো বলেন, ‘কুরআন, সুন্নাহ, আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত, আল্লাহর নবীর সুন্নত এর বাহিরে গিয়ে তোমরা সফলতা পাবে না, মুক্তি পাবে না। এখন যারা তোমাদেরকে পরিচালনা করতে চায়, তাদের পেছনে পড়লে তোমাদের দুনিয়াও বরবাদ, আখেরাতও বরবাদ। দুনিয়াতে বরবাদ— এটা হয়তো কোনো সময় টের পাবে; কোনো সময় টের পাবে না। আখেরাতের বরবাদ— এটা তো একেবারেই চোখ বন্ধ হওয়ার পর থেকে শুরু হয়ে যাবে।’
এরপরে খতীব সাহেব আয়াত পাঠ করেন,
وَٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلْمُتَّقِينَ তরজমা: আল্লাহ মুত্তাকীদের বন্ধু।
আয়তের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় মুহতারাম বলেন, ‘এরা (পশ্চিমারা) তোমাদের বন্ধু হতে পারেনা। তারা তো একে অপরের বন্ধু। তোমাদের বন্ধু একমাত্র কে? আল্লাহ। তোমাদের অভিভাবক একমাত্র কে? আল্লাহ; যদি তাকওয়া অবলম্বন কর। এপারে খতীব সাহেব আরো বলেন, ‘এই শরীয়ত ছাড়া মানুষের তাকওয়া হবে না। আল্লাহ শরীয়তের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েই বলেছেন وَٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلْمُتَّقِينَ (আল্লাহ মুত্তাকীদের বন্ধু)।’
খতীব সাহেব বলেন, ‘যার কাছে ইসলাম নাই, ঈমান নাই, শরীয়*ত নাই, হিম্মত নাই, ওহীর জ্ঞান নাই— তাকে তুমি অনুসরণ করবে? তাকে তুমি তোমার রাহাবার বানাবে? তাদেরকে রাহাবার বানালে তোমার কোন ফায়দা হবে না।
এরপরে খতীব সাহেব আয়াত তিলাওয়াত করেন—
هَٰذَا بَصَٰٓئِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ
তরজমা: এটা (কুরআন) সমস্ত মানুষের জন্য প্রকৃত জ্ঞানের সমষ্টি এবং যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।
আয়াতের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় খতীব সাহেব বলেন, ‘আল্লাহর দেয়া এই শরীয়ত এই শরীয়ত যে কোরআনের মধ্যে আছে যে হাদিসের মধ্যে আছে এগুলো হলো মানুষের জন্য بصائر মানে তুমি যদি পথ খুঁজে পেতে চাও নির্দেশনা পেতে চাও তাহলে নির্দেশনা এই কোরআনের মধ্যে এ হাদিসের মধ্যে আল্লাহর দেয়া এই শরীয়তের মধ্যে এখানে নির্দেশনা এখানে হেদায়েত এটা হল পথ–هُدًى وَرَحْمَةٌ–হেদায়েত এখানে, রহমত এখানে; যদি তুমি বিশ্বাসী হয়ে থাকো।
এরপরে শরীয়তের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মুহতারাম আব্দুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ বলেন, “যদি তুমি বিশ্বাসী হয়ে থাকো, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থাকে, ঈমান থাকে, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস থাকে, তাহলে তোমার পথ পশ্চিমাদের দেখানো — সেটা না। অমুসলিমরা যেটা দেখায়, সেটা না। ইহুদিরা, খ্রিস্টানরা যেটা দেখায়, সেটাও না। মুশরিকরা যেটা দেখায়, সেটাও না। তোমার পথ হলো আল্লাহ যেটা দেখান, সেটা।”
কোনটা বৈষম্য, কোনটা সমতা— ওটা তো আল্লাহ ভালো জানেন। আল্লাহর কুরআন থেকে শেখো। কুরআন–সুন্নাহ বাদ দিয়ে আপনি সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে যাবেন, সম্ভব না। পরে সমতার নামে বৈষম্য হবে। সমতা যদি জানতে চাও, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তুমি সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাও, তাহলে কোরআন থেকে হেদায়েত নাও! তাকওয়ার জিন্দেগি প্রতিষ্ঠা কর! কুরআনের শিক্ষা, নবী করীম ﷺ-এর সুন্নতের অবজ্ঞা করে তুমি সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাও, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করো, কিন্তু তুমি সমতার শিক্ষা কুরআন থেকে হাসিল করনি; তাহলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কী হবে? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতি অবিচার হবে; যদি তুমি সমতা প্রতিষ্ঠা কর, অথচ কুরআন সম্পর্কে তুমি বে-খবর, সুন্নাহ সম্পর্কে বে-খবর! কারণ, সমতার শিক্ষা কুরআন-সুন্নাহর বাইরে তুমি পারলে দেখাও!’ খতিব সাহেব বলেন ‘আমানত, সততা, সত্যবাদিতা আর দুর্নীতি এক হতে পারে হতে পারে না।’
ঈমানের আলোচনার শেষদিকে এসে খতীব সাহেব বলেন, ‘বাধ্য করে আল্লাহ কাউকে মুসলমান বানান এই বিধান আল্লাহ দেননি শরীয়তে। আল্লাহ ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছেন, সবাই ঈমান আনো। আল্লাহ বলেন নাই, বাধ্য করে কাউকে মুসলমান বানাও— এর মানে কী?;আল্লাহ তায়ালা অমুসলিমদেরকে আল্লাহর জমিনে নিরাপদে থাকতে দিচ্ছেন। তাদের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা দিয়েছেন। অথচ তারা আল্লাহর বিদ্রোহী, কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করেন শান্তিতে আছে কি না সে? শান্তিতে নাই।’
মুহতারাম আরো বলেন, ‘অমুসলিমরা যদি জানত, একজন মুমিন ঈমানের কারণে কত শান্তিতে থাকে, তার দিল কত প্রশান্ত; যদি অমুসলিমরা জানতো—সব অমুসলিম একসাথে ঈমান আনত। কিন্তু আমরা ঈমান ওয়ালারা–ঈমানের নিয়ামত যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন–ঈমানটা তো সেরকম হতে হবে না কি? আমাদের ঈমানটা তো মজবুত হতে হবে?’ঈমানের আলোচনার শেষে খতীব সাহেব বলেন, ‘ঈমান যত মজবুত হবে, তত শান্তি আর প্রশান্তি বুঝতে পারবো আমরা নিজের জীবনে। মানুষের জিন্দেগীতে কষ্ট আসতে পারে। সব সময় সুস্থ থাকবে, তা না। অসুস্থতা আছে, রোগব্যাধি হয়, বিভিন্ন পেরেশানি আসে, কষ্ট হয়, কিন্তু এই কষ্ট-রোগব্যাধি-পেরেশানি সবকিছুর মধ্যে আত্মার প্রশান্তি, দিলের প্রশান্তি—এটা কিসের কারণে হয়? ঈমানের কারণে।’
শান্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে— আলোচনায় খতীব সাহেব বলেন, ‘শান্তি তো দিতে পারবে ইসলাম। শান্তি আসবে ইসলামী শরীয়তে। আলো আসবে ইসলামী শরীয়তের অনুসরণে। বুঝতে পেরেছেন ভাই? এবং সমতা, বৈষম্য এসব শিক্ষা কার কাছ থেকে নিতে হবে? শরীয়তের কাছ থেকে নিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সেই তৌফিক আমাদের দান করেন। আমিন
সংস্কার ভালো জিনিস। কিন্তু সংস্কার শিক্ষা কার কাছ থেকে নিতে হবে? সংস্কারের সম্পর্কে নবী করীম ﷺ বলেছেন। ১০ম হিজরীতে নবী করীমের ইন্তেকাল। হাদীসটি নবীজি যখন বলেন তখন ১০ম হিজরী কিংবা ১১তম হিজরী শুরু— এই সময় নবী করিম ﷺ এ হাদীসটি বলেছেন, ‘প্রতি শতাব্দীর মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল্লাহর কিছু নেক বান্দাকে দাঁড় করিয়ে দিবেন, তৌফিক দিয়ে দেন, হিম্মত দান করেন, কিসের জন্য? يجدد امر دينها (দীনের সংস্কারের জন্য) আবু দাউদ সহ অনেক হাদিসের কিতাবে এ হাদিসটা আছে।
হাদীসের ব্যাখ্যায় খতীব সাহেব বলেন, ‘ইলমের চর্চা কমে গেলে। তখন মানুষের মাঝে কি এসে যায়? সুন্নতের জায়গায় বেদাত এসে যায়। আলোর জায়গায় অন্ধকার এসে যায়। তখন মানুষ অনেক সময় ভুল কাজকে মনে করে, এটা সঠিক। অনেক বেদাতকে মনে করে, এটা সুন্নত। হারামকে মনে করে হালাল। একবারে অশ্লীলতা, মনে করে এটাই ভালো, সুন্দর। সুন্দরকে অসুন্দর, অকল্যাণকে কল্যাণ মনে করে— এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয় ওহীর চর্চার অভাবে, ইলমের অভাবে। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল্লাহর কিছু নেক বান্দা; যাদের কাছে সহীহ ইলম আছে, তাকওয়া আছে—আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হিম্মত দিয়ে দেন। তারা সবকিছু সংস্কার করে দেয়।’
মুজাদ্দিদ কাকে বলে— আলোচনায় মুহতারাম বলেন, ‘দীন, শরীয়তের মধ্যে বিভিন্নজন অপব্যাখ্যা করে বা মূর্খতার কারণে যে সমস্ত গলত কথা বলে, এখন গলতকে যদি মানুষ সহীহ মনে করে, হেদায়েত মনে করে, শরীয়ত মনে করে, তাদেরকে আল্লাহ প্রতিরোধ করে দেয় যে, দেখো! আল্লাহ কুরআনে এটা বলেছেন, আল্লাহর নবী হাদিসে এটা বলেছেন। তোমরা যেটা ধারণা করছো, ওটা ঠিক না। ওটা ভুল। ওটা গোমরাহী। হেদায়েতের রাস্তা এটা। এভাবে সংস্কার করেন। তাদেরকে বলা হয় মুজাদ্দিদ।’
সংস্কার কাকে বলে— আলোচনায় খতীব সাহেব বলেন, ‘যারা মানুষকে গোমরাহীর পথে নিয়ে যাচ্ছে, বিদআতকে সুন্নত বলছে— এরাও তো একটা কাজ করে, না কি? এটাকে সংস্কার বলতে পারেন আপনি? এটার নাম সংস্কার না। সংস্কার কিসের নাম? প্রত্যেক জিনিসকে হেদায়েতের উপর নিয়ে আসা, সুন্নতের উপর নিয়ে আসা— এটা হল সংস্কার।
এরপরে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন খতিব সাহেব৷ তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের এই দেশ খুব কঠিন হালতে আছে। একটা স্পর্শকাতর অবস্থায় আছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি সমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সেজন্য আমাদের সংস্কার করার প্রয়োজন হচ্ছে বিভিন্ন সেক্টরে। এখন সমতা সৃষ্টি করতে গিয়ে যদি বৈষম্য সৃষ্টি করা হয় সমতার নামে, তাহলে এটা অন্যায় হবে কি না? অন্যায় হবে। জুলুম হবে। আল্লাহর নাফরমানি হবে। এবং জুলাই–আগস্ট চব্বিশের শহীদদের সাথে গাদ্দারী হবে— এ কথা মনে রাখতে হবে।
প্রকৃত সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে খতীব সাহেব তুলে ধরেন, ‘প্রকৃত সংস্কার যদি চাই তাহলে কুরআন-সুন্নাহ— এটা পশ্চিমারা দিবে না। কিছুদিন বৃটেনের তালে চললাম, কিছুদিন আমেরিকার তালে চলবো, কিছুদিন রাশিয়ার তালে চলব— না, না, না,, এসব কিছুর পরীক্ষা হয়ে গেছে المجرد لا يجرد অর্থাৎ পরীক্ষিত জিনিসের আরেকটা পরীক্ষা করতে হয় না।’
এরপরে মুহতারাম আফসোস করে বলেন, ‘এতদিন এই রাস্তায় চললাম শান্তি পেলাম না। এখন আরেক রাস্তায় চলে দেখি, শান্তি আছে কি না? আহারে ভাই! শান্তির রাস্তা তো আল্লাহর দিয়ে দিয়েছেন কুরআনে!!’
এরপরে খতীব সাহেব খুব গুরুত্বের সাথে বলেন, ‘যেকোনো সংস্কারের আগে, যেকোনো সমতার নামে কিছু প্রতিষ্ঠা করার আগে, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা জেনে নেবেন— আল্লাহ কী বলেছেন, আল্লাহর রাসূল কী বলেছেন।’
এলজিবিটি—এটা কি সমতা না বৈষম্য? কী দেখছি আমরা? কী শুনতে পাচ্ছি এসব? সংস্কারের কথা আমরা বলছি। সংস্কার করে পশ্চিমা সভ্যতা টেনে নিয়ে আসব? সংস্কার করে পশ্চিমা সভ্যতা, সভ্যতার নাম না। সংস্কার পতিতালয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার নাম নয়।
সংস্কার সমকামীতাকে স্বীকৃতি দেয়ার নাম নয়। পুরুষকে মেয়ে বানানো মেয়েকে পুরুষ বানানোর নাম নয়। এটা তো ১০০ ভাগের ১০০ ভাগ বৈষম্য।আল্লাহর এই জমিনে, তাওহীদের জমিনে, মুসলিম উম্মতের এই জমিনে আমরা চাই কারো মাঝে কোন ধরনের না–ইনসাফি হোক! কারো প্রতি কোন ধরনের বৈষম্য না হোক! কিন্তু কোনো মাধ্যমে আল্লাহর দৃষ্টিতে বৈষম্য, আল্লাহর রাসূলের দৃষ্টিতে বৈষম্য, আল্লাহর দেয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈষম্য এবং সাধারণ দিনের যুক্তির আলোকে বৈষম্য— ওটাকে সমতার নাম দিয়ে, সংস্কার নাম দিয়ে এই জমিনে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে চান, আমরা তাদের কাছে ক্ষমা চাই। আল্লাহর ওয়াস্তে আল্লাহ কে ভয় করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।
সাদিক শাহরিয়ার
- সাদিক শাহরিয়ার#molongui-disabled-link
- সাদিক শাহরিয়ার#molongui-disabled-link
আতাউল্লাহ আয়মান
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link
- আতাউল্লাহ আয়মান#molongui-disabled-link