বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অস্থিরতায় ভুগছে। একক ঋণগ্রহীতার জন্য নির্ধারিত এক্সপোজার সীমা বারবার লঙ্ঘন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতির কারণে এই সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদনের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিক ঋণ বিতরণ করেছে। এর ফলে, একদিকে বড় ঋণগ্রহীতা গ্রুপগুলো বিপুল অঙ্কের ঋণ নিলেও সেগুলো এখন অনেকাংশে খেলাপি হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে, কোনো ব্যাংক তার পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একজন গ্রাহককে দিতে পারে না। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এই সীমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে, যা তাদের পরিশোধিত মূলধনের ৯৫০ শতাংশ।
এই বিপুল অঙ্কের ঋণ খেলাপি হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য বড় গ্রুপগুলোও একই ধরনের সুযোগ নিয়েছে। এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে, যা ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ বিবেচনার সুযোগে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো নিয়ম ভেঙে ঋণ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
• ওরিয়ন গ্রুপ: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১০,৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন পেয়েছিল
।• বসুন্ধরা গ্রুপ: স্বর্ণ শোধনাগার প্রকল্পের জন্য পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ২,৭২৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়।
• এস আলম গ্রুপ: জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যা তাদের পরিশোধিত মূলধনের ৪৫১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার নীতিমালা শিথিল করে এসব অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাংক খাতের নথি অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করে সর্বাধিক ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক।
খেলাপি ঋণের উর্ধ্বগতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১,২৬,১১১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে:
• জনতা ব্যাংক: ৬০,৪৮৯ কোটি টাকা
• অগ্রণী ব্যাংক: ২৬,৮৯১ কোটি টাকা
• সোনালী ব্যাংক: ১৬,৬২৩ কোটি টাকা
• রূপালী ব্যাংক: ১২,৭৩৮ কোটি টাকাবিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে এই ঋণের বড় অংশ আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
এই সংকটের জন্য বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই দায়ী করছেন। সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ঋণের সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি দিয়েছে, তাই আইন থাকার কার্যকারিতা হারিয়েছে।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘একক ঋণগ্রহীতার জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া সুশাসনের মধ্যে পড়ে না। এটি বড় ঋণগ্রহীতাদের সামর্থ্যের বাইরে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিল নীতি এবং বিশেষ বিবেচনার অপব্যবহারের ফলে দেশের ব্যাংক খাত ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আইন ও নীতির সঠিক প্রয়োগ এবং সুশাসন নিশ্চিত না করা গেলে এই সংকট আরও গভীর হবে। ব্যাংক খাতকে রক্ষা করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী ভূমিকা ও স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন জরুরি।