গত ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পরিচিত এই ২৫ বছর বয়সী তরুণের মৃত্যু দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্য তার মৃত্যু নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। ১৬ জুলাই আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। এরপর তার মৃত্যু নিয়ে নানা তথ্য ও মতামত সামনে আসে।
২৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। এতে শেখ হাসিনা দাবি করেন, আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন: “গুলিবিদ্ধ হলে সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসা করে বুলেট বের করা যেত এবং হয়তো তাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু তার সঙ্গীরা তাকে চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এত দেরি হওয়ার কারণে চিকিৎসা করার সুযোগও পাওয়া যায়নি।”
এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ায়। বিরোধীরা দাবি করেন, এটি সঠিক নয় এবং এটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা।
তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার শেখ হাসিনার বক্তব্য খতিয়ে দেখে। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যথাসম্ভব দ্রুতই আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
বেলা ২টা ১৮ মিনিট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।
বেলা ২টা ২৭ মিনিট একটি রিকশায় করে আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বেলা ৩টা ৫ মিনিট আবু সাঈদ মৃত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছান।
প্রমান সমূহ
• বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির একটি ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, ২টা ১৮ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
• ১৬ জুলাই ‘Fahmed Riad’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, ২টা ২৭ মিনিটে রিকশায় আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
• দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস এবং ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেলা ৩টা ৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন
দ্য ডেইলি স্টার (১৬ জুলাই, বিকাল ৪টা ১ মিনিট): সংঘর্ষ দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের দিকে শুরু হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আবু সাঈদকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।
প্রথম আলো (১৬ জুলাই, সন্ধ্যা): সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সাঈদ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও পথেই মৃত্যু হয়।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: হাসপাতালের মৃত্যুর প্রমাণপত্র অনুযায়ী, ৩টা ৫ মিনিটে তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন
ঘটনার দুই মাস পর প্রকাশিত ময়নাতদন্তে বলা হয়,
• মৃত্যুর কারণ: ছররা গুলিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
• সাঈদের মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত ছররা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
• ফিমোরাল আর্টারি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল।
• মাথার বাঁ দিকে আঘাতের চিহ্ন ছিল, তবে এটি মৃত্যু ঘটায়নি।
চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন: “গুলির কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়েছিল। বিশেষ করে ঊরুর ফিমোরাল আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং শকের ফলে মৃত্যু ঘটে। মাথায় আঘাত ছিল, তবে সেটি গুরুতর নয়।”
শেখ হাসিনার দাবির অসঙ্গতি
রিউমার স্ক্যানার ও অন্যান্য প্রমাণ থেকে স্পষ্ট, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আবু সাঈদকে চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে নয়, বরং দ্রুতই হাসপাতালে নেওয়া হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে তিনি হাসপাতালে পৌঁছান।
আবু সাঈদের মৃত্যু একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। তবে এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো দুঃখজনক। শেখ হাসিনার বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয় এবং এটি আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
সত্য হলো, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যথাসম্ভব দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তবে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়। এ ধরনের ঘটনার সঠিক তথ্য প্রচার এবং দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।