ঘড়িতে সময় ১২টা ৩৪ মিনিট। মসজিদের ভেতরটা নিস্তব্ধ। এক অদ্ভুত সুর যেন ছড়িয়ে আছে চারপাশে—গভীর প্রতীক্ষার সুর। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
তখনই দরজার দক্ষিণ দিক থেকে এক চিলতে নড়াচড়া দেখা গেল। সেই নিস্তব্ধতা এক মুহূর্তের জন্যও যেন ভেঙে গেল। কয়েকজন মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তাদের মাঝখানে সম্মানিত খতীব সাহেব। চেহারায় এক ধরনের আলোকময়তা। মসজিদের পরিবেশ যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। খতীব সাহেব ধীরে ধীরে মিম্বারের পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। তার মুখে একটা নরম হাসি। মুসল্লীদের উদ্দেশ্য সালাম পেশ করলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’
তার কণ্ঠ মসজিদের নিস্তব্ধতাকে যেন আরও প্রশান্ত করে তুলল। এরপরে ধীরে ধীরে হামদ সানা পাঠ করলেন। সানার শেষে তাআউয, তাসমিয়াহ পাঠের পরে সূরা কাহফের ১৪-১৬ আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন—
وَرَبَطْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ ٱلسَّمَـٰوَٟتِ وَٱلْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَا۟ مِن دُونِهِۦٓ إِلَـٰهًۭا ۖ لَّقَدْ قُلْنَآ إِذًۭا شَطَطًا ° هَـٰٓؤُلَآءِ قَوْمُنَا ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةًۭ ۖ لَّوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِم بِسُلْطَـٰنٍۢ بَيِّنٍۢ ۖ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًۭا ° وَإِذِ ٱعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ فَأْوُۥٓا إِلَى ٱلْكَهْفِ يَنشُرْ لَكُمْ رَبُّكُم مِّن رَّحْمَتِهِۦ وَيُهَيِّئْ لَكُم مِّنْ أَمْرِكُم مِّرْفَقًۭا….
হামদ সানা পাঠের পরে সম্মানিত খতীব সাহেব প্রথমেই বলেন, ‘মুমিনের ঈমানের পরে সবচেয়ে বড় সিফাত হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ার সর্ব প্রথম কথা তাওহীদ। لا نعبد الا الله (অর্থ: আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করব) পার্থনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর দরবারে। اياك نعبد واياك نستعين (অর্থ: আমরা আপনারই এবাদত করি এবং একমাত্র আপনার কাছে সাহায্য চাই)—এটা হল তাকওয়ার প্রথম সবক।
এরপরে মুহতারাম তাওহীদ সংশ্লিষ্ট কিছু দোয়া পাঠ করেন—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর | লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ | লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিসীনা লাহুদ-দীন….
মুহতারাম বলেন, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। বিপদাপদ থেকে মুসিবত থেকে একমাত্র আল্লাহ’ই রক্ষা করতে পারেন। কোনো কল্যাণ একমাত্র আল্লাহই দিতে পারেন। অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়া, কোনো কল্যাণকে ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহই দিতে পারেন। আমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত করবো। সকল নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ হতে। সবর, পেরেশান, যা কিছু আছে সব আল্লাহর পক্ষ হতে। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করা যাবে না। ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর।’
ইবাদাত কেমন হবে—এবিষয়ে মুহতারাম আলেচনা করেন, ‘مخلصين له الدين— ইবাদত হবে সঠিক নিয়তে, ইখলাসের সাথে ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য।’
এরপরে মুহতারাম উল্লেখ করেন আনুগত্যের বিষয়। তিনি বলেন, ‘ইবাদত এবং পূর্ণ আনুগত্য হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত হবে না। ওই সকল ক্ষেত্রে অন্যের আনুগত্য করা যাবে, যেখানে আল্লাহর অনুমতি আছে। নবী রাসূলের জন্য আল্লাহ অনুমোদন দিয়ে দিয়েছেন। সকল নবী রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। নবী রাসূলদের মধ্যে সর্বশেষ নবী হলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার শরীয়ত এবং সুন্নতের আনুগত্যের মধ্যেই একমাত্র নাজাত।’
এরপরে মুহতারাম উল্লেখ করেন, مخلصين له الدين ولو كره الكافرون— কাফের মুশরিকরা যতই অসন্তুষ্ট হোক; ইবাদত একমাত্র কার? আল্লাহর।
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব তেলাওয়াত করেন,إِنِّى وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِى فَطَرَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ حَنِيفًاۖ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ অর্থ: আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। [সূরা আনআম, আয়াত: ৭৯] এই আয়াত পাঠ করে সারমর্ম তুলে ধরে মুহতারাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘এটাই ঈমানের দাবি।’মু
হতারাম আরো বলেন, ‘আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করবো, আমি কাউকে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না।’ এরপরে আয়াত পাঠ করেন, إِنَّ صَلَاتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَٰلَمِينَ [সূরা আনআম, আয়াত: ১৬২]
আয়াতের সাবলীল তরজমা ও ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমার সালাত, আমার সকল ইবাদত, আমার কুরবানী একমাত্র আল্লাহর জন্য। আমার হায়াত, আমার জীবন, আমার মউত একমাত্র আল্লাহর জন্য— এই তাওহীদের নির্দেশ আমাকে দেওয়া হয়েছে। সকল নবীকে আল্লাহ তাওহীদের নির্দেশ দিয়েছেন। আখেরী নবীকেও তাওহীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সকল উম্মতকে আল্লাহ তাওহীদের নির্দেশ দিয়েছেন। মুক্তির পথ একমাত্র তাওহীদ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মােটকথা, তাকওয়ার প্রথম সবক তাওহীদ।’
এরপরে মুহতারাম আলেচনা করেন তাকওয়ার দ্বিতীয় সবক নিয়ে। তিনি বলেন, ‘তাকওয়ার দ্বিতীয় সবক শরীয়ত। শরীয়ত মানে তাকওয়া। তাওহীদ এবং শরীয়তের অনুসরণ এ দুটি মিলে ঈমান হয়। এই দুটি মিলেই ইসলাম হয়। যদি শরীয়ত না মানা হয়, তাহলে ঈমান এবং ইসলাম সম্পূর্ণ হবে না। তাকওয়ার প্রথম সবক তাওহীদ—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। তাকওয়ার দ্বিতীয় সবক শরীয়ত।’
তাওহীদ এবং শরীয়তের বিষয়ে মুহতারাম বলেন, ‘তাওহীদ ও শরীয়ত না হলে ঈমান হয় না, ইসলাম হয় না। ঈমান এবং ইসলাম হবে না, যদি না শরীয়ত মানে। আল্লাহর দেয়া শরীয়ত মানলে মুমিন সফল হবে। তাওহীদ— লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ—থেকেই মানব আগমণের শুরু। প্রথম মানব আদম আলাইহিস সালাম। আদম আলাইহিস সালাম দুনিয়াতে তাওহিদের বার্তা নিয়ে এসেছেন। তিনি সর্বপ্রথম দুনিয়াতে তাওহীদের সবক নিয়ে এসেছেন। আদম সন্তানরা তাওহীদের উপরে ছিল। তারপরে শয়তানের ধোঁকায় আস্তে আস্তে তাওহীদের জায়গায় শিরক অবলম্বন করেছে, আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করেছে।’
এরপরে খতীব সাহেব আলোচনা করেন দুনিয়ার প্রাচীন ধর্ম নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম তাওহীদের ধর্ম। প্রাচীন মানে? এটাই শুরু। মানবতার শুরু হয়েছে তাওহীদ দিয়ে— লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মানবতার শুরু হয়েছেই এভাবে যে, সে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত, আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেনই এ কথা বলে, خليفة ‘খলিফা’। অর্থাৎ তাওহীদের দাওয়াত দিবে শরীয়ত মেনে চলার দাওয়াত দিবে।’
এরপরে মুহতারাম তিলাওয়াত করেন, لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًاۚ অর্থ: তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক (উম্মত)-এর জন্য আমি এক (পৃথক) শরীয়ত ও পথ নির্ধারণ করেছি। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৪৭]
এরপরে খতীব সাহেব বলেন, ‘তাওহীদ এবং শরীয়ত— এ দুটো মিলেই ঈমান। এই দুটো দিয়েই শুরু মানবতার। শিরক এসেছে আরো পরে। শিরক হচ্ছে মানুষের বানানো, শয়তানের ধোঁকায়, শয়তানের কুমন্ত্রনায় এগুলো আবিষ্কার হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা শিরকের প্রতি সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট। আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে হবে। মুমিনের কাজ হল তাওহীদকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা।’
এরপরে মুহতারাম মুশরিকদের অসারতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে একাধিক উপাস্যের পূজা করা এর কোন বাস্তবতা নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, هَٰٓؤُلَآءِ قَوْمُنَا ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةًۖ لَّوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِم بِسُلْطَٰنٍۭ بَيِّنٍۖ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا অর্থ: এরা আমাদের কওম, তারা তাঁকে ছাড়া অন্যান্য উপাস্য গ্রহণ করেছে। কেন তারা তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? অতএব যে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা রটায়, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? [সূরা কাহফ, আয়াত: ১৫]
আয়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় মুহতারাম বলেন, ‘আমাদের পরিচিত সুরা সুরাতুল কাহাফের এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা অমুসলিমদের কথা আলোচনা করেছেন। যারা এই যুবকদেরকে শিরক করতে বাধ্য করেছিল। তাই এই যুবকেরা ঈমান বাঁচানোর জন্য পাহাড়ের গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুশরিকদের সামনে এসব লোকেরা ঈমানকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে নিজেই ঘোষণা করেছেন, আমি তোমাদের এই ঘটনা বর্ণনা করব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, نَّحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُم بِٱلْحَقِّۚ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ ءَامَنُوا۟ بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَٰهُمْ هُدًى অর্থ: আমি তোমার কাছে তাদের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল একদল যুবক, যারা নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে হিদায়াতে প্রভূত উৎকর্ষ দান করেছিলাম। [সূরা কাহফ, আয়াত: ১৩]
এই যুবকদেরকে বাদশার দরবারে হাজির করা হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَرَبَطْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا۟ فَقَالُوا۟ رَبُّنَا رَبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَا۟ مِن دُونِهِۦٓ إِلَٰهًاۖ لَّقَدْ قُلْنَآ إِذًا شَطَطًا [সূরা কাহফ, আয়াত: ১৪]
খতীব সাহেব আয়াতের সাবলীল তরজমা ও ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমি তাদেরকে সৎ সাহস দিয়েছি। তাই তারা বাদশাহর সামনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, আমাদের রব একমাত্র আল্লাহ। আসমান জমিনের রব একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করব আমরা। আমাদের রব একমাত্র আল্লাহ। আমরা অন্য কোন উপাস্য মানি না। অন্য কোন রবের কথা বললে তো আমরা অবাস্তব কথা বলব। কারণ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সত্য এবং মহাসত্য কথা হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এর পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন: هَٰٓؤُلَآءِ قَوْمُنَا ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةًۖ لَّوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِم بِسُلْطَٰنٍۭ بَيِّنٍۖ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا [সূরা কাহফ, আয়াত: ১৫]
এই যে আমাদের সম্প্রদায়ের এই লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এ ব্যাপারে কোন দলিল পেশ করে না কেন? আসলে বাস্তবতা হলো যারা অন্যান্য উপাস্য বিশ্বাস করে তাদের এ ব্যাপারে কোন প্রকার দলিল নাই! আর ইতিপূর্বেও তারা এ পক্ষে কোন দলিল দিতে পারেনি এবং কেয়ামত পর্যন্ত কোনদিন পারবে না। মুশরিকরা যদি এ ব্যাপারে দলিল গ্রহণ করে, তবে তারা সাথে সাথেই তাওহীদ গ্রহণ করে ফেলবে। মুসলিম হয়ে যাবে।’
এরপরে মুহতারাম আয়াতের—فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا—এই অংশের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তাদের চেয়ে বড় জালিম আর কেউ নেই। তারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করে। মাবুদ একমাত্র আল্লাহ, অথচ তারা তাদের পূজা–উপাসনা–প্রার্থনা সবকিছুর মধ্যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে। সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে শিরক।’
এরপরে খতীব সাহেব তুলে ধরেন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট। সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘মুমিনের কাছে সবচেয়ে দামি নেয়ামত ও সম্পদ হলো তাওহীদ। এর জন্য মুমিন জান দিতে রাজি, ঈমান ছাড়তে রাজি না। শুধুমাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার অপরাধেই তো এই যে কয়েকদিন আগে সাইফুল ইসলামকে হত্যা করা হলো। তাওহিদের কালিমা বলার কারনেই তো? (মুসল্লীরা সমস্বরে ঠিইইইইইইক!) তার তো অন্য কোন দোষ ছিল না। এর জন্য তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সে তো সফল। তার প্রতি ফোঁটা রক্ত আল্লাহ তায়ালার নিকট দামি। আর তাকে যারা হত্যা করেছে, তার হত্যাকে সমর্থন করেছে তাদের সকলের জন্য তার প্রতিটি ফোঁটা রক্ত এক একটি জাহান্নাম! (মুসল্লীরা সমস্বরে ঠিইইইইইইক!) আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দেই। দুনিয়ার সব বাদ। সব জায়গায় অবিচার হলেও আল্লাহ তা’আলা সঠিক বিচার করে দিবেন। (মুসল্লীরা সমস্বরে ঠিইইইইইইক!) আমরা বিচার না দিলেও আল্লাহর আদালতে সঠিক বিচার হবেই হবে!
মুহতারাম আরো বলেন, ‘এই যে মুসলিম উম্মত— তারা নিরাপত্তায় আছে নাকি হিন্দুরা নিরাপত্তায় আছে? তাদের নিরাপত্তার অবস্থা তাে এরকম যে, তারা মুসলমানদেরকে কুপিয়ে হত্যা করে! এসব নিরেট ষড়যন্ত্র! আমাদের সকলকে বুঝতে হবে। ষড়যন্ত্র বুঝার বাকি থাকলে আপনি ভুলের মধ্যে আছেন!’
খতীব সাহেব জাতির উদ্দেশ্য আরো বলেন, ‘এগুলো হলো দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এটা বুঝতে হবে। এখনো যদি বুঝতে বাকি থাকে যে এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না? তারপরে কি অবস্থা হবে বলেন? এখনো যদি এই ধরনের সংগঠনগুলো, যারা এই ধরনের কান্ড ঘটায়— তাদের ব্যাপারে সন্দেহ থাকে যে এদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দরকার কিনা! এখনো যদি সন্দেহ থাকে, বুঝতে বাকি থাকে, তাহলে আমরাও জানি কল্যাণ কীসে হবে। (মুসল্লীরা সমস্বরে ঠিইইইইইইক!)
পরিশেষে মুহতারাম বলেন, ‘তাওহীদ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ— কারো ভয়ে এই ঈমান হারানো যাবে না। এই ঈমান, এই তাওহীদ, এই শরীয়ত— এটা তো এত বড় নেয়ামত, এত বড় সম্পদ যে, এটার সামনে আমার জান–মালসম্পদ কিচ্ছু না। কারো ভয়ে তাওহীদের নেয়ামত ছাড়া যাবে না।’
এরপরে অমুসলিমদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন সম্মানিত খতীব সাহেব। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সবার জন্য দোয়া করি এবং দাওয়াত দিই—তোমরা তাওহীদের পথে আসো। তোমাদের ধর্মগ্রন্থে তাওহীদের কথা আছে— সেগুলো লুকিয়ে রাখা কেন? ওখানে তাওহীদের কথা আছে, ওখানে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর কথা আছে।’
এরপরে তিনি বলেন, ‘এই বাস্তবতা স্বীকার করে তাওহীদের রাস্তা গ্রহণ করো। দুনিয়াতেও সফল হবে, আখেরাতেও সফল হবে। তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার অধিকার সেই ব্যক্তিরই রয়েছে, যার নিজের জীবনে তাওহীদ রয়েছে এবং সে সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল।’
এরপরে খতীব সাহেব বলেন, ‘আজকের সমাজে কিছু গোষ্ঠী বিভিন্ন কৌশলে মুসলমানদের থেকে ঈমান কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। খ্রিস্টান মিশনারিরা গরিব, ঋণগ্রস্ত এবং অসহায় মানুষের কাছে সহায়তার নাম করে তাদের নিজেদের ধর্মে টানতে চায়। একইভাবে কাদিয়ানীরা মুসলিম নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করছে। তারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতো একজন মিথ্যে নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে।’
এরপরে কাদিয়ানীদের মিথ্যাচার সম্পর্কে মুহতারাম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘কাদিয়ানীরা মুসলিমদের কালিমা ব্যবহার করে প্রতারণা চালায়। তাদের নিজেদের কোনো হেদায়েত নেই, অথচ তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব কাদিয়ানী ধর্মের অসারতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী হিসেবে মানে, অথচ ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর কোনো নবী আসবে না। নবী করীম ﷺ-এর স্ত্রীদেরকে আমরা উম্মুল মু’মিনীন বলি, মুমিনদের মা। আর কাদিয়ানীদের উম্মুল মুমিন গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর স্ত্রী। আমরা সাহাবী বলি যারা রাসূল ﷺ-এর উপর ঈমান এনে রাসুলের সহচর্য গ্রহণ করেছে। আর কাদিয়ানীরা যারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সহচর্য গ্রহণ করেছে তাদেরকে সাহাবী বলে।’
খতীব সাহেব আরো বলেন, ‘একমাত্র মুসলিম উম্মাহর কাছেই প্রকৃত হেদায়েত এবং তাওহীদের বার্তা রয়েছে। কুরআনুল কারীম হলো একমাত্র অবিকৃত গ্রন্থ, যা আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেছেন এবং নিজেই এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বলেন:إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ অর্থ: আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমি তা সংরক্ষণ করব।
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব খ্রিস্টানদের ইঞ্জিল এবং ইহুদিদের তাওরাত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টানদের কাছে যে ইঞ্জিল রয়েছে, সেটি আর আল্লাহর পাঠানো আসল ইঞ্জিল নয়। এটি বিকৃত হয়ে বাইবেল বা “কিতাবুল মুকাদ্দাস” নামে পরিচিত। একইভাবে, ইহুদিদের দাবি করা তাওরাতও বিকৃত। একমাত্র কুরআনুল কারীমই অবিকৃত এবং এটি কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।’
এরপরে কুরআনে কারীমের বিষয়ে মুহতারাম বলেন, ‘কুরআনুল কারীম শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি মানবজাতি এবং জিন জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও হেদায়েতের বার্তা। এই বার্তা সর্বজনীন এবং সমস্ত যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক। এটি সংরক্ষণের পাশাপাশি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, হাদিস এবং শরীয়তকেও সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।’
এরপরে, বর্তমান সময়ে দাওয়াতের কাজে মুসলমানরা বাঁধাপ্রাপ্ত হয় বিভিন্ন স্থানে— এবিষয়ে সম্মানিত খতীব সাহেব বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহ যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাওয়াতি কাজ করে, তখনও তাদের বিরুদ্ধে নানা বাধা সৃষ্টি করা হয়। অথচ খ্রিস্টান মিশনারি এবং কাদিয়ানীদের দাওয়াত দেওয়ায় কোনো বাধা আসে না। এটি সমতা নয়, বরং একটি বড় বৈষম্য।’
সম্মানিত খতীব সাহেব আরো বলেন, ‘দেশের আইনে যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতে কিছু থাকে, সেটি অবশ্যই বাদ দিতে হবে।’ তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনে সমকামিতা নিষিদ্ধ। এটি একটি ভালো নীতি। কিন্তু যদি এর বিপরীতে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটি কোনো সংস্কার হবে না। বরং বিদ্যমান ভালো নীতিগুলোকে আরও মজবুত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সত্যিকারের সংস্কার মানে হলো ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে কোনো আইন তৈরি করা হয়, তাহলে সেটি কোনো সংস্কার নয়। বরং এটি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শামিল।’
খতীব সাহেব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, ’যেটা আপত্তিকর, শরীয়ত বিরোধী, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা, সেটা কখনাে সংস্কার হতে পারে না। এটা বাতিলের সংস্কার।’
এরপরে আলোচনার শেষপর্যায়ে এসে সম্মানিত খতীব সাহেব বর্তমান সময়ের ‘তথ্য সন্ত্রাস’-এর বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান যুগে ‘তথ্য সন্ত্রাস’ একটি ভয়াবহ সমস্যা। তথ্য সন্ত্রাস মজলুমকে জালিম বানিয়ে দেয় এবং জালিমকে মজলুম হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সত্যকে মিথ্যার মাধ্যমে ঢেকে দেয়। তিনি বলেন, ‘তথ্য সন্ত্রাস— এটা সন্ত্রাসের চেয়েও বড় অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ধরনের সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। ভাঙচুর, তথ্য সন্ত্রাস কিংবা অন্য যে কোনো সন্ত্রাস—সবকিছুর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
পরিশেষে মুহতারাম বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন, কল্যাণের তৌফিক দিন এবং সকল অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন।وآخر دعوانا عن الحمد لله رب العالمين‘
টিম নিউজনেস্ট
- টিম নিউজনেস্ট#molongui-disabled-link
- টিম নিউজনেস্ট#molongui-disabled-link
- টিম নিউজনেস্ট#molongui-disabled-link
- টিম নিউজনেস্ট#molongui-disabled-link