নিউজনেস্ট

শাবান মাস ও শবে বরাতের তাৎপর্য, সূক্ষ্ম শিরক থেকে সতর্কতা 

শাবান মাস ও শবে বরাতের তাৎপর্য, সূক্ষ্ম শিরক থেকে সতর্কতা 
শাবান মাস ও শবে বরাতের তাৎপর্য, সূক্ষ্ম শিরক থেকে সতর্কতা। ছবি: নিউজনেস্ট

الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه ونعوذ بالله من شرور انفسنا ومن سيئات اعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له واشهد ان لا اله الا الله وحده لا شريك له واشهد ان محمدا عبده ورسوله اللهم صل على سيدنا ومولانا محمد النبي الامي وعلى اله وصحبه وسلم تسليما 

اللهم اجعل صلواتك ورحمتك وبركاتك على سيد المرسلين وامام المتقين  وخاتم النبيين محمد عبدك ورسولك امام الخير وقائد الخير ورسول الرحمة اللهم ابعثه مقاما محمودا يغبطه به الاولون والاخرون

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم. بسم الله الرحمن الرحيم. يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ 

وقال النبي صلى الله عليه وعلى اله وسلم: يطلع الله ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن 

صدق الله مولانا العظيم وصدق رسوله النبي الكريم ونحن على ذلك من الشاهدين والشاكرين والحمد لله رب العالمين

আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শোকর আদায় করছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হায়াত দান করেছেন, সুস্থ রেখেছেন। আমরা পবিত্র শাবান মাস পেয়েছি এবং আশা করছি, রামাদানুল মোবারকও পেয়ে যাব। ইনশাআল্লাহ। 

রামাদানুল মোবারক বরকতপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি চান্দ্র মাস। যে মাসের সাথে ইসলামের অনেক বিধান, অনেক স্মৃতি জড়িত। রামাদানের আগে আবার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শাবান মাস দান করেছেন। এ মাসেরও কিছু বৈশিষ্ট্য এবং কিছু ফজিলত রয়েছে। 

নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসেই নফল রোজা রাখতেন। সব মাসেই কিছু কিছু নফল রোজা রাখতেন। প্রতি সোমবারেই রোজা রাখার অভ্যাস ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। প্রতি বৃহস্পতিবারে রোজা রাখার অভ্যাস ছিল। এবং প্রতি চান্দ্র মাসের তিন দিন রোজা রাখতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। 

সাধারণত (আরবি মাসের) ১৩-১৪-১৫ এগুলোকে ‘আইয়ামুল বিজ’ বলা হয়। এই তিন রোজার চান্দ্র মাসের শুরুতেও রাখা যায় এবং শেষেও রাখা যায়। যার যেটা অভ্যাস। এভাবে প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখতেন। কিন্তু শাবান মাস রাসুল কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন। 

কাজেই যার শক্তি আছে সামর্থ্য আছে সে শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখলে রমজান মাসে তার রোজা রাখা কষ্ট হবে না। তার জন্য শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা ভালো। কিন্তু মূল হলো রমজান মাস। যাতে আমি রমজান মাসে পরিপূর্ণ রোজা আদায় করতে পারি, রাতে তারাবি পড়তে পারি, সেজন্য আমার সুস্থতা দরকার। এটার খেয়াল রাখতে হবে। 

এমনিভাবে আমরা অন্যান্য মাসে রোজা রাখি, সে হিসেবে শাবান মাসেও রাখতে পারি। এটা রাখলেও আমরা এ ফজিলত পেয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। অতিরিক্ত নফল রোজা রাখা ওই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, যার শারীরিক অবস্থা মানসিক অবস্থা এমন যে, শাবান মাসে বেশি পরিমাণে রোজা রাখলেও রমজান মাসে পরিপূর্ণভাবে রোজা রাখতে পারবে এবং তারাবি পড়তে পারবে। 

শাবান মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, যেটা দিয়েই অনেকে শাবান মাসকে চিনে। শবে বরাত। মধ্য শাবানের যে শবে বরাত। বারাআতের রাত। মানে গোনাহ এবং অপরাধ থেকে মাগফিরাত হাসিল করা, ক্ষমা পাওয়া, গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার রাত। এজন্য এটাকে লাইলাতুল বারাআত বলা হয় আরবিতে। ফারসিতে শবে বরাত। এই ফারসি শব্দটাই আমাদের বাংলা ভাষায় অধিক প্রচলিত। শবে বরাত। 

হাদিসে এটাকে বলা হয়েছে: ليلة النصف من شعبان অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিন শেষ হলে যে রাত, সেটা ১৫ শাবানের রাত। ১৫ তারিখের রাত হওয়ার কারণে সেটা ليلة النصف من شعبان যেহেতু রাত আগে আসে, ১৫ শাবানের রাত। 

সূর্য ডুবে যাওয়ার পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যেকোন রাত বোঝায়। মাগরিবের সময় যখন হয় ইফতারের সময় হয় তখন থেকে নিয়ে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। এটা হল শরিয়তের ভাষায় রাতের সময়। লাইলাতুল কদরও এতটুকই, লাইলাতুল বারাআতও এই পরিমাণই। 

এ রাতের একটি বৈশিষ্ট্য হাদিস শরিফে এসেছে। হাদিসের সহিহ ইবনে হিব্বান গ্রন্থসহ আরও বিভিন্ন কিতাবেও আছে: রাসুল কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবি, মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: 

يطلع الله ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن

আল্লাহ তাআলা দৃষ্টি দান করেন অর্থাৎ রহমতের দৃষ্টি দান করেন نصف شعبان এর রাতে। অর্থাৎ ১৫ শাবানের রাত। শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশেষ দৃষ্টি দান করেন, রহমতের দৃষ্টি দান করেন। ফলে সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহর যত মাখলুক আছে সবাইকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। 

দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষমা পায় না। সবার জন্য ক্ষমার ঘোষণা কিন্তু দুই শ্রেণীর মানুষ এই মাগফিরাত পাবে না। مشرك এবং مشاحن। মুশরিক ব্যক্তি ক্ষমা পাবে না। আর ক্ষমা পাবে না সেই ব্যক্তি, যে তার অন্তরে অপর ভাইয়ের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ করে। 

ক্ষমা পেতে হলে তাওবা করতে হবে, অন্তরকে পরিষ্কার করতে হবে। এই গুনাহের কারণে যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে, তাদের সাথে সম্পর্ক পরিষ্কার করতে হবে। এরপরই আল্লাহর মাগফিরাত লাভ করা সম্ভব। শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তা’আলা ব্যাপকভাবে ক্ষমা ও মাগফিরাতের ঘোষণা দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি অন্তরে হিংসা ও শত্রুতা পোষণ করে, সে এই ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই শবে বরাতের বিশেষ ফজিলত পেতে হলে এই কথাগুলো মনে রাখতে হবে।

এছাড়াও অন্যান্য হাদিসে আরও কিছু পাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সহিহ ইবনে হিব্বানের হাদিসে এই দুইটি গুনাহের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। এই দুইটি গুনাহের মধ্যে একটি হল শিরক। 

শিরক দুই ধরনের হতে পারে: একটি হল হিন্দুদের মতো মুশরিকদের মতো শিরক করা, যা ইসলামের পরিপন্থী। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের ভিত্তিই হল শিরকের উপর। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের প্রতিটি শাখায় শিরকের উপাদান রয়েছে। তবে ইসলামে কিছু সূক্ষ্ম শিরকের কথাও বলা হয়েছে, যেগুলোকে ‘শিরকে আসগর’ বা ছোট শিরক বলা হয়।

অন্যদিকে যে শিরকের কারণে তাওহিদ নষ্ট হয়ে যায়, তাকে ‘শিরকে আকবর’ বলা হয়। শিরকে আকবর থেকে বাঁচতে না পারলে ঈমানই সাব্যস্ত হয় না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের নেয়ামত দান করেছেন, তাওহিদের নেয়ামত দিয়েছেন। তাই তাঁর শোকর আদায় করতে হবে এবং সচেতন হতে হবে, যাতে সূক্ষ্ম শিরক বা ছোট ছোট শিরক থেকে মুক্ত থাকা যায়। এজন্য আমাদেরকে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তাওফিক চাইতে হবে। আমিন।

বড় শিরক বা শিরকে আকবর হল এমন কাজ যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা হয়। যেমন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা, কবরের তাওয়াফ করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মান্নত করা বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা। আমাদের হাত উঠবে শুধুমাত্র আল্লাহর দরবারে। কারণ, আমরা সুরা ফাতেহায় বলি: ‘(হে আল্লাহ!) আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’

উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বে যত বিষয় আছে, সব কিছুর প্রার্থনা শুধুমাত্র আল্লাহর দরবারেই করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কোন কিছু চাওয়া শিরকের শামিল। এই কথাটি আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। উপায়-উপকরণের মধ্যে যত বিষয় আছে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাওয়াও শিরক। তাই আমাদেরকে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে এবং শিরক থেকে দূরে থাকতে হবে।

সন্তান দান একমাত্র আল্লাহর কাজ। যখন কোন ব্যক্তির বিয়ের বয়স হয় এবং সে সন্তান কামনা করে, তখন অন্যরা তাকে বিয়ে করিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু বিয়ে করার পরও যদি এক বছর, দুই বছর বা তিন-চার বছর পরও সন্তান না হয়, তাহলে হতে পারে কোন শারীরিক সমস্যা রয়েছে, যা চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার তাকে চিকিৎসা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

তবে সব চিকিৎসা শেষ করার পরও যদি সন্তান না হয়, তাহলে সন্তান কে দিতে পারেন? একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তাই এখন প্রশ্ন হলো, সন্তানের জন্য আপনি মাজারের দিকে দৌড়াবেন নাকি আল্লাহ তাআলার দরবারে দাঁড়াবেন? অবশ্যই আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে। 

অন্যের কাছে দোয়া চাওয়া যেতে পারে, যেমন বলা যায়, ‘আমার জন্য দোয়া করুন।’ এটা দোয়া চাওয়ার একটি পদ্ধতি। কিন্তু কাউকে বলে, ‘আমার সন্তান নেই, আপনি আমার সন্তানের ব্যবস্থা করে দিন’—এ ধরনের প্রার্থনা করা যাবে না। এ ধরনের প্রার্থনার জন্য অনেকেই মাজারে যায়, যেমন শাহজালালের দরগায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইবাদত ও দোয়ার দরবার একটাই, তা হলো আল্লাহ তাআলার দরবার। আল্লাহর কোনো নেক বান্দা বা অলির দরবার প্রার্থনার স্থান হতে পারে না। তাদের কাছে চাওয়া যাবে না, বরং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়া যেতে পারে।

আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী, আমরা কি তাঁর কাছে চাই নাকি তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে চাই? অবশ্যই আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। কোন সাহাবি, অলি বা বুজুর্গের কবর জিয়ারত করার সময় আখেরাতের কথা স্মরণ করা যায়। তবে সেখানে নিজের জন্য এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হবে। 

কবর বা মাজারের কাছে সরাসরি চাওয়া যাবে না। কবর বা মাজারের জন্য মান্নত করাও জায়েজ নয়। মান্নত করতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। মান্নতের অর্থ গরিব, মিসকিন ও অসহায়দের মাঝে বিতরণ করতে হবে। মান্নতের টাকা ধনী বা সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারবে না। এ টাকা জনকল্যাণমূলক কাজেও ব্যবহার করা যাবে না। মান্নতের অর্থ সরাসরি গরিব ও অসহায়দের হাতে পৌঁছাতে হবে। যদি গাইরুল্লাহর জন্য মান্নত করা হয়, তাহলে তা হারাম এবং সেই অর্থ মালিকেরই থেকে যাবে।

মাজারে যে দানের বাক্স রাখা হয়, তার বেশির ভাগই গাইরুল্লাহর মান্নতের দান। যেহেতু এই অর্থের মালিকানা স্পষ্ট নয়, তাই এটি গরিব ও মিসকিনদের হক। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো এই দানের বাক্স উঠিয়ে দেওয়া এবং এই প্রথা বন্ধ করা। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। যদি ধনী ব্যক্তি বা সন্ত্রাসীরা এই টাকা নেয়, তাহলে তা আরও বড় হারাম কাজ হবে। এই অর্থ গরিব ও মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। যেমন, বন্যায় যাদের ঘর নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের ঘর বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মুশরিক শবে বরাতে ক্ষমা পাবে না। ঈমান বাঁচানোর জন্য শিরক থেকে দূরে থাকতে হবে। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং দোয়া একমাত্র আল্লাহর কাছেই করতে হবে। মান্নতও শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। এছাড়া যেসব কাজে শিরকের ছোঁয়া রয়েছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন, শপথ বা কসম একমাত্র আল্লাহর নামেই করতে হবে। গাইরুল্লাহর নামে কসম করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বিভিন্ন বিষয়ের শপথ করেছেন, কিন্তু সেটা আলাদা বিষয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা হলেন সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। তিনি কোন বিষয়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এভাবে শপথ করেছেন। আমাদের উচিত শিরক থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও দোয়ায় মনোনিবেশ করা। 

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বহু জায়গায় বহু বিষয়ের শপথ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তো খালেক ও মালিক, তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বিষয়ের শপথ করেছেন। তবে তার বান্দাদের জন্য তিনি যে বিধান দিয়েছেন, তা হলো—শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামেই শপথ করতে হবে, অন্য কারও নামে নয়।

গাইরুল্লাহ নামে শপথ, একটি বড় অন্যায়

গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু) এর নামে শপথ করা একটি বড় অন্যায়। এটি শিরকের একটি ধরন, তবে তা বড় শিরক নয়। ছোট শিরকগুলোর মধ্যে এটিও একটি। অনেক মানুষ সম্মানের জন্য মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়, এমনকি মানুষের পায়ে মাথা ঠেকায়। এখনো অনেকেই বিভিন্ন মাজার ও দরবারে মাথা ঠেকায়। অথচ ইসলাম সম্মানের জন্য এমন কাজ নিষিদ্ধ করেছে।

সম্মানসূচক সেজদা—হারাম ও শিরক

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সম্মান প্রকাশের সঠিক পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো সালাম। السلام عليكم ورحمة الله সালামের মাধ্যমেই মানুষকে সম্মান জানানো হবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। অপর ব্যক্তি সালামের জবাব দেবে— وعليكم السلام

এরপর মুসাফাহা (করমর্দন)। যদি মুসাফাহার সুযোগ থাকে তাহলে করমর্দন করা এবং একে অপরের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা— يغفر الله لنا ولكم এটিই ইসলামি শরিয়তে রয়েছে।

নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল— أينحني له؟ অর্থাৎ, ‘আমরা কি সম্মানের জন্য মাথা ঝুঁকাব?’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্টভাবে বলেছেন—না, কখনো নয়। বরং সালাম দাও, মুসাফাহা করো; কিন্তু মাথা ঝুঁকাবে না। যখনই মাথা ঝুঁকানো নিষেধ, তখন কারও পায়ে সিজদা করা তো আরও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

মাজারে বা দরবারে যে সিজদা করা হয়, তা হারাম। আর যদি কেউ মনে করে যে, ওই ব্যক্তি সবকিছুর মালিক, সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, তার হাতেই জন্ম-মৃত্যু নির্ধারিত—তাহলে এটি বড় শিরক। কাউকে লাভ-ক্ষতির মালিক মনে করা, কারও দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে মনে করা, সন্তান জন্ম দেওয়ার মালিক মনে করা—এগুলো আরও ভয়ংকর শিরক এবং সম্পূর্ণ হারাম।

শিরক থেকে বেঁচে থাকা জরুরি

আমরা যদি মুসলিম হতে চাই, মুমিন থাকতে চাই, তাহলে বড় বড় শিরক থেকে তো বাঁচতেই হবে। পাশাপাশি ছোট ছোট সূক্ষ্ম শিরকগুলোকেও চিনে নেওয়া এবং তা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।

মূল বিষয়ে আসি, বড় বড় শিরক তো আরো অনেক কিছুই রয়েছে। আলোচনা করা সম্ভব নয়, তাই আজ অল্প করে বললাম। সময় হলে আরো বিস্তারিত আকারে বলবো ইনশাল্লাহ- আল্লাহ যদি তাওফিক দেন।

হাদিসে যে দ্বিতীয় অংশ আছে অর্থাৎ, أو شاحن অন্যের প্রতি যে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে, সে এই রাতের যে বিশেষ ফজিলত-মাগফিরাত সেটা সে পাবে না। তবে তুমি যদি আলাদা করে তওবা করো এবং হিংসা করতে গিয়ে যদি কারো অন্যায় ভাবে হক নষ্ট করো এবং সেটার ক্ষতিপূরণ আদায় করো তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। তাহলে যার দিলের ভিতরে শত্রুতা বা হিংসা বিদ্বেষ রয়েছে সে ব্যাপক মাগফেরাতের যে ঘোষণা দিয়েছে অর্থাৎ, يغفر لجميع خلقه সেটার আওতায় সে পড়বে না।

তবে কেউ যদি আমার সাথে হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করে বা আমার ক্ষতি করে তাহলে কি তার প্রতি আমার বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না বা তার সাথে শত্রুতা করা যাবে না? এই প্রশ্ন কিন্তু অনেকেই করে। আর এমনটা কিন্তু সব জায়গায় হয়- পরিবারে, সমাজে, জায়গায় জায়গায় এমনটা দেখা যায়। একজন আরেকজনের উপরে জুলুম করে অন্যায় করে এক পর্যায়ে তার প্রতি অন্তরে ঘৃণা এসে যায়, তার প্রতি এক সময় এক ধরনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে শরিয়ত যেটা বলে সেটা হল, তোমার উপরে কেউ যদি জুলুম করে অন্যায় করে তাহলে তুমি সেটার প্রতিবাদ করতে পারবে। এবং তার জুলুম থেকে বাঁচার জন্য বৈধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। তোমার হক নষ্ট করেছে সে সেই হক আদায় করার জন্য তুমি বৈধ পন্থায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এটাতে কোন আপত্তি নেই; তবে একজন মুমিন হিসেবে তোমার দিল একদম স্পষ্ট থাকতে হবে, পরিষ্কার থাকতে হবে। পাশাপাশি এই বিষয়টিও পরিষ্কার থাকতে হবে যে, সে যে কাজটি করছে সেটি ভুল এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তার জন্য দোয়া করতে হবে, আল্লাহ তাআলা তাকে যেন অন্যায় কাজ থেকে বাঁচার তাওফিক দান করেন।

তিনি আরও বলেন, তার কোন ক্ষতি হলে তাতে খুশি হওয়া যাবে না যে, তার ক্ষতি হয়েছে হোক এটা ভালই হয়েছে তার এমন ক্ষতি হওয়াই দরকার এ ধরনের কথাবার্তা বা কল্পনা মনের মধ্যে আনা যাবে না। শত্রুর ক্ষতিতে খুশি হয়ে যাওয়া এবং তার কোন লাভ বা উপকার হলে এতে বেজার হয়ে যাওয়া এটাও মুমিনের সিফাত নয়। কোন মুমিনের অন্তর বা মনোভাব এমন হওয়া উচিত নয়।

তার শত্রুতার কারণে আপনার যে ক্ষতি হবে সেটার হক আপনি উসুল করেন। সে যেন আপনারও কোন ক্ষতি না করতে পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন কিন্তু তার লাভ হলে বা উপকার হলে আপনি খুশি হবেন বা তার ক্ষতি হলে আপনি বেজার হবেন এমনটা হওয়া ঠিক নয় ।

তবে অন্তরে তার ব্যাপারে কোন শত্রুতা বা হিংসা বিদ্বেষ রাখা যাবে না। মুমিনের বন্ধুর ব্যাপারে ও তার শত্রুর ব্যাপারে তার দিলটা থাকবে পরিষ্কার। বন্ধ হোক বা শত্রু সকলের ব্যাপারে মনটাকে এমন পরিষ্কার রাখা যে তার কোন কল্যাণে আমি মন খারাপ করব না বা তার কোন অকল্যাণে আমি হাসবো না। এমনকি আমার শত্রুরও যদি কোন ক্ষতির হালতে চলে আসে যে, আমি তার সাহায্য করতে সক্ষম তবুও তার সাহায্য আমি করি না এমনটি যেন না হয়।

সে আমার শত্রু হলেও মুমিন হিসেবে তার কিছু হক রয়েছে বা মানুষ হিসেবে হলেও তার কিছু হক আমার উপরে রয়েছে। ঐ হক যাতে আমি লঙ্ঘন না করি, এটা খেয়াল রাখা। এটাই হল ইসলামের শিক্ষা।

তিনি বলেন, উপরের হাদিসের মর্মার্থ হল কারো ব্যাপারে এরকম শত্রুতা পোষণ করা এটা ঠিক নয়। হয়ত স্বভাবগত হিসেবেই তার পক্ষ থেকে আমি কষ্ট পেয়েছি দেখে তার প্রতি আমার মনটা অন্যান্য মানুষের মত নয়, এমন যদি হয় তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন । সে আমাকে কষ্ট দিবে সে আমার সাথে শত্রুতা করবে আর আমি তার প্রতি নরম হয়ে যাব এটা মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়া অনেক কঠিন। তাই আল্লাহ তায়ালা সেটিকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আপনি সেটিকে জিইয়ে রেখে  তার প্রতি ক্ষোভ রেখে দেবেন এটা আবার ঠিক নয়।

যদি আপনি এমন শত্রুতা পোষণ করেন যে, আল্লাহ তায়ালা তার উপর কোন রহম করেছেন, এতে আপনি নাখোশ হয়ে গেছেন বা তার কোন ক্ষতি হয়েছে, এতে আপনি খুশি হয়ে গেছেন, এটা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। মুমিনের অন্তরের উপরে এতোটুকু কন্ট্রোল অন্তত থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই তাওফিক দান করেন। আমিন।

আর সাবান এবং রজব মাস আমাদেরকে জানান দেয় যে, আমাদের সামনে একটি ফজিলতপূর্ণ বরকতপূর্ণ মাস আসছে। আর সেটা হল রমজানুল মোবারক। তাই সেটার জন্য প্রস্তুত হওয়া। এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া। বিশেষ করে রমজানের পূর্বেই রমজানের জন্য একটি বিশেষ রুটিন করা, যেন রমজানের রোজা এবং তারাবিতে কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে।

কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত সম্পর্কে শায়েখ বলেন, দেখেন কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত এটা পুরো বছরের আমল। কিন্তু রমজানুল মোবারকে! এটা তো রমজান মাস কোরআনের মাস তাই এই মাসে বেশি বেশি কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করা।

কোরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তেলাওয়াত কম করব না বেশি করব এর আগের কথা হল, তেলাওয়াতটা তো শুদ্ধ হতে হবে। তাই এই রমজানে কোরআন তেলাওয়াত টা শুদ্ধ করতে হবে। কোরআন শরিফ শুদ্ধ করে পড়া, এটা ফরজ। আর এই রমজানে এই মসজিদে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কোরআন শেখানো হবে। অল্প একটু সময়, আসর থেকে মাগরিব। এ সময়টুকুতেই কুরআন শরীফকে শুদ্ধ করে পড়ার চেষ্টা করবেন। 

আমাদের কোরআন পড়তে হয়, নামাজ পড়তে হয় । আর নামাজের মধ্যে তো কোরআন তেলাওয়াত করতে হয়, তাই না? সুরা ফাতেহা তো কোরআনের এই একটি অংশ। সাথে সাথে অন্যান্য সূরা মিলাতে হয় তাই এগুলোকে শুদ্ধ করে শিখতে হবে। কোরআন সহিহ-শুদ্ধ করে শেখা, এটা কোরআনের হক, এটা নামাজের হক, বিশেষ করে এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর হক। তাই কোরআনকে সহিহ শুদ্ধভাবে শিখতে হবে। আমি কিন্তু শুধু কোরআনকে শিখতে বলিনি বরং বলেছি সহিহ্শুদ্ধ করে শিখতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এটার জন্য প্রস্তুত হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।

واخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

টিম নিউজনেস্ট
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত