ঢাকার মিরপুরে ‘বিজয় রাকিন সিটি’ নামে বৃহৎ এক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে, যা মূলত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের কল্যাণে বরাদ্দ করা হয়েছিল। ৫০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই প্রকল্পে মোট ১,৯৫০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৮৭০টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। তবে অভিযোগ উঠেছে, এর প্রায় অর্ধেক ফ্ল্যাট এখন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে।
১৯৯৭ সালে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতি’। পরবর্তী সময়ে আরও ২৫১ জন এতে যুক্ত হন। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মিরপুরে ১৬.২ একর জমি বরাদ্দ দেয়। এরপর ২০১০ সালে রাকিন ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়, যেখানে ঠিক হয় যে, প্রকল্পের ৪৩ শতাংশ ফ্ল্যাট পাবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি এবং বাকি ৫৭ শতাংশ পাবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।
তথ্য অনুযায়ী, সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নামে অন্তত ৭০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে ফ্ল্যাট বণ্টন করে নিজের প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রেখেছেন। এমনকি রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের সদস্যপদ দিয়ে ফ্ল্যাট দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ফ্ল্যাট পাওয়ার অধিকারী হলেও তাদের মধ্যে অনেককে রাজনৈতিক বিবেচনায় বঞ্চিত করা হয়েছে। বরং সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শত শত ফ্ল্যাট।
প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, ফ্ল্যাট পাওয়া প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন—আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লুৎফুল আহমিনা খান, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক ও বেনজির আহম্মেদসহ আরও অনেকে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজনের নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বহু ফ্ল্যাট।
নথি অনুযায়ী, মোর্শেদুল আলম তার স্ত্রী, ছেলে, ভাই-বোন, শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগ্নে-ভাতিজাসহ পরিবারের ৩০ জনেরও বেশি সদস্যের নামে ৭০টি ফ্ল্যাট নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে এসব ফ্ল্যাট নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ায় তাঁরা চরম বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাঁরা ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পুনরায় যাচাই করে সঠিক বণ্টনের দাবি জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মো. বেলায়াত হোসেন বলেন, ‘মোর্শেদুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা সমিতিকে বিতর্কিত করেছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও দলীয় নেতাদের ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে।’
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নূরুল বাসির জানান, ‘সমিতির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। কেউ যদি অবৈধভাবে সদস্যপদ নিয়ে ফ্ল্যাট পেয়ে থাকে এবং তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য বরাদ্দ করা ফ্ল্যাট যেভাবে দলীয় নেতা ও প্রভাবশালীদের হাতে চলে গেছে, তা দুর্নীতির ভয়াবহ উদাহরণ। এ নিয়ে একটি স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। অন্যথায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ লুটপাটের এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকবে।







