ভারতের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। দেশটিতে তারল্য সংকট এতটাই তীব্র যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার নিলামে তুলতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট আরও গভীর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ব্যাংকিং খাতে নগদ অর্থের প্রবাহ এতটাই কমে গেছে যে, ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে এবং পুরো অর্থনীতি ধীরগতিতে চলছে। সংকট এতটাই গুরুতর যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ডলার নিলামে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে আরবিআই।
১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি
এই নিলামের আওতায় প্রথম ধাপে ১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হবে, যা থেকে প্রায় ৮৭০ বিলিয়ন রুপি সংগ্রহের আশা করা হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ সংকট নিরসনের জন্য যথেষ্ট নয়।
এর আগে, চলতি বছরের শুরুতে ছয় মাসের জন্য ৫১০ কোটি ডলারের মুদ্রা বিনিময় নিলাম করেছিল আরবিআই। কিন্তু এতেও সংকট কাটেনি। ব্যাংক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আগামী মাসগুলোতে আরবিআইকে আরও অন্তত ১ লাখ কোটি রুপি সরবরাহ করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এবারের তিন বছর মেয়াদি নিলাম আগের স্বল্পমেয়াদি রেপো সুবিধার তুলনায় ভালো হতে পারে, তবে এটি সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়। ব্যাংক অফ বরোদার অর্থনীতিবিদ অদিতি গুপ্তা বলেন, তিন বছরমেয়াদি বিনিময় নিলামের ফলে সুদের হার কমার সম্ভাবনা থাকলেও তারল্য সংকট এতটাই গুরুতর যে, এই সিদ্ধান্তের বাস্তবিক সুফল পাওয়া কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি নগদ অর্থের অভাব চলতে থাকে, তাহলে সুদের হার কমানোর কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আরবিআইয়ের এই নিলাম শুধু তারল্য সংকট মোকাবিলার জন্য নয়, বরং এটি রুপির অবমূল্যায়নেরও ইঙ্গিত বহন করছে। অদিতি গুপ্তা বলেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে রুপির মান কমানোর চেষ্টা করা হতে পারে।
বর্তমানে ভারতীয় রুপি আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রুপির মান আরও কমতে পারে, যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেবে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
গত পাঁচ সপ্তাহে ওপেন মার্কেট অপারেশন (ওএমও), দীর্ঘমেয়াদি রুপি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপি সরবরাহ করেছে আরবিআই। কিন্তু এত বড় অঙ্কের নগদ অর্থ বাজারে ছাড়ার পরও সংকট কাটছে না, বরং আরও গভীর হচ্ছে।
ভারতের অর্থবিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিন বছরমেয়াদি এই নিলাম স্বল্পমেয়াদি সরকারি বন্ডের জন্য ইতিবাচক হতে পারে, তবে এটি পুরো অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়। বরং এটি সাময়িকভাবে বাজারকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা মাত্র।
ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত ভারতের ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি রুপি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মার্চ মাসে এই ঘাটতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে আরবিআইয়ের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। তারা আপাতত সংকট সামাল দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ কতদিন কার্যকর থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত ভারতের এই সংকট দেশটির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সংকট দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।