নিউজনেস্ট

ভারতে মুসলিম ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় বাধা, বিজিপির টার্গেটে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

ভারতে মুসলিম ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় বাধা বিজেপির, টার্গেটে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
ভারতে মুসলিম ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় বাধা বিজেপির, টার্গেটে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ছবি: সংগৃহীত

‘আমরা শিশুদের বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, ঐতিহ্যগত মোল্লা ও ধর্মীয় নেতা নয়!’ মঙ্গলবার এমন মন্তব্য করেছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। কিন্তু এই বক্তব্যের কয়েকদিন আগেই বিজেপি শাসিত দুই রাজ্যে দুটি মুসলিম মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অভিযান চালানো হয় এবং এক বিতর্কিত অভিযোগে তার প্রধানদের গ্রেপ্তার করা হয়।

আসামে মসলিমদের প্রতি হিংসাপরায়ণ আক্রমণ

২২ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আসাম পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)—যাদের মূল দায়িত্ব সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা—তারা গুয়াহাটির বাসভবন থেকে মেঘালয়ের প্রখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মেঘালয়ের (ইউএসটিএম) চ্যান্সেলর মাহবুবুল হককে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ, তিনি পরীক্ষায় দুর্নীতি করেছেন! একই দিনে রাজস্থান পুলিশ জোধপুরের মৌলানা আজাদ ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতিক গৌরিকে গ্রেপ্তার করে।

ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। সচার কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মুসলিম শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪% উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছে। এই অবস্থার উন্নতি সাধনের পরিবর্তে বিজেপি সরকার মুসলিম মালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই টার্গেট করছে।

ইউএসটিএম ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণ

২০২৪ সালের আগস্টে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ইউএসটিএম ও মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলতে থাকেন। প্রথমে তিনি হককে ‘বন্যা জিহাদ’ চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এরপর দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারের গম্বুজ মক্কার মতো দেখতে, যা ‘জিহাদের প্রতীক’। তিনি এমনকি ঘোষণা দেন, ইউএসটিএম থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের আসামে চাকরি দেওয়া হবে না।

এবার কোন প্রমাণ ছাড়াই, তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারি, জাল ডিগ্রি প্রদান এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

তবে ইউএসটিএম কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, এসব ভিত্তিহীন প্রচার কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে করা হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে ইউএসটিএম শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নয়, বরং এটি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ৮০ জনের বেশি হিন্দু ও উপজাতীয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছেন। ২০২৪ সালে এটি ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (NAAC) থেকে ‘A’ গ্রেড পায়, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

সম্প্রতি ইউজিসি-নেট পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ৫০ জনের বেশি ইউএসটিএম শিক্ষার্থী এই সম্মানজনক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান ও বিজেপির ভিত্তিহীন অভিযোগকে একেবারে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।

মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ধারাবাহিক দমননীতি

উত্তর প্রদেশে বিজেপি সরকার মোহাম্মদ আলী জওহার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা আজম খান ২০১৯ সাল থেকে সীতাপুর কারাগারে রয়েছেন। ২০১৯ ও ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে ৯০টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে মহিষ ও ছাগল চুরির মতো হাস্যকর অভিযোগও রয়েছে।

২০২১ সালে যোগী সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ হেক্টর জমি বাজেয়াপ্ত করে।

অনিশ্চয়তার মুখে গ্লোকাল ইউনিভার্সিটি

২০২৪ সালের ১৪ জুন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সাহারানপুরের গ্লোকাল ইউনিভার্সিটির ১২১ একর জমি এবং বিল্ডিং সাময়িকভাবে জব্দ করে। যার মূল্য ৪,৪৪০ কোটি টাকা।

এই সম্পত্তির মালিক আবদুল ওহিদ এডুকেশনাল অ্যান্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। অভিযোগ, অবৈধ খনন থেকে পাওয়া ৫০০ কোটিরও বেশি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনা ও নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে।

এই মামলায় প্রাক্তন বিধায়ক মোহাম্মদ ইকবাল পলাতক, এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি দুবাইয়ে রয়েছেন। তার চার ছেলে ও ভাই বিভিন্ন মামলায় জেলবন্দি।

বিজেপির মুসলিম শিক্ষাবিরোধী নীতি

বিজেপি নেতারা প্রায়ই দাবি করেন, তারা মুসলিম শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষা দিতে চান এবং এজন্য মাদরাসা বন্ধ করতে চান। কিন্তু বাস্তবে তাদের পদক্ষেপ সম্পূর্ণ বিপরীত।

এমনকি মোদি সরকার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এএমইউ) সংখ্যালঘু স্বীকৃতি বাতিলের চেষ্টা করেছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের বেঞ্চ ঐতিহাসিক এক রায়ে ৪:৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ১৯৬৭ সালের আজিজ বাশা মামলার রায় উল্টে দিয়ে এএমইউ’র সংখ্যালঘু মর্যাদা পুনর্বহাল করে।

সংবিধান লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা

মুসলিম মালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষভাবে টার্গেট করা বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পরিচায়ক। এটি সংবিধানে সংখ্যালঘুদের জন্য নিশ্চিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার লঙ্ঘন।

বিজেপির প্রকৃত লক্ষ্য যদি মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় অগ্রসর করা হতো, তাহলে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংস না করে বরং উৎসাহিত করতো। কিন্তু বাস্তবে, তারা মুসলিমদের উন্নতি আটকানোর জন্য একের পর এক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত