আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের চলমান সংকট নিয়ে তুরস্কের ইস্তানবুলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরাকান হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এনজিওস ফেডারেশন (IDSB)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে আলোচকরা রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান দমন-পীড়ন ও মানবিক বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং তাদের জন্য জরুরি ত্রাণ সহায়তা ও আন্তর্জাতিক সংহতির আহ্বান জানান।
সেমিনারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও তুর্কি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন দেখানো হয়, যেখানে কয়েক দশকের নির্যাতন, গণহত্যা ও সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি-র সংঘাতের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় তুলে ধরা হয়।
আরাকান হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিম নূর বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘর্ষে রোহিঙ্গারা চরম সংকটে পড়েছে। নির্বিচারে গোলাবর্ষণ, জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ, আটকের নামে নির্যাতন, সম্পত্তি দখল—এমনকি নারীদের ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ চালানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, এই সেমিনারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, যাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়।’
সেমিনারে তুরস্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। কেউ বললেন, কিভাবে তাদের পরিবার একবেলা খেয়ে পরের বেলার খাবারের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, আবার কেউ জানালেন, কীভাবে তাদের স্বজনরা মিয়ানমারের কারাগারে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রয়েছেন।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা এখানে পড়াশোনা করছি ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিন জানতে পারি আমাদের আত্মীয়দের কেউ না কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে।’
আলোচনায় উপস্থিত তুর্কি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, সিরিয়া ও ইয়েমেন সংকটের মতো রোহিঙ্গাদের বিষয়েও বিশ্বমিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এনজিওস ফেডারেশনের প্রতিনিধি রজব সুংগুল বলেন, ‘আমরা দেখছি, রোহিঙ্গাদের সংকট নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তুরস্কের সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে আমরা বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে পারি।’
সেমিনারের শেষ অংশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়—
• জরুরি খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো
• রোহিঙ্গাদের সংকট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রম জোরদার করা
• শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে তোলা
• দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য গবেষণা ও নীতিগত উদ্যোগ নেওয়া
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কাজ করে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়ের সহিংসতার শিকার। বাংলাদেশে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ সমুদ্রপথে বিপজ্জনক যাত্রা করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তবে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেন এবং বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
সূত্র : আরাকান নিউজ এজেন্সি