নিউজনেস্ট

ভারতে হিন্দু উৎসব ও সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি

ভারতে ধর্মীয় উৎসব ও রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আরএসএস এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় উৎসবগুলোর ব্যবহার বাড়িয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক কুম্ভ মেলা এর একটি বড় উদাহরণ।

কুম্ভ মেলা ভারতীয় হিন্দুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থযাত্রা। শত শত বছর ধরে এটি হয়ে আসছে, যেখানে লাখো ভক্ত গঙ্গায় পবিত্র স্নান করতে আসে। কিন্তু এবারের আয়োজন ছিল আগের চেয়ে আলাদা। মেলাটিকে ধর্মীয় আয়োজনের বাইরে নিয়ে গিয়ে জাতীয় প্রচারণার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

মেলার বিশাল আয়োজনে উত্তর প্রদেশ সরকার সরাসরি যুক্ত ছিল। রাজ্য সরকার শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাই করেনি, বরং রাজনৈতিক প্রচারণার জন্যও ব্যবহার করেছে। পুরো মেলা প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিশাল বিশাল পোস্টার লাগানো হয়েছিল।

মেলায় একটি নতুন প্রবণতা দেখা গেছে—মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কট করা। গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে মুসলিম দোকানিরা খাবারে থুতু দেয়। অথচ ইতিহাস বলে, মুঘল সম্রাট আকবর কুম্ভ মেলার জন্য বিশেষ ঘাট ও শৌচাগার নির্মাণ করেছিলেন, যাতে তীর্থযাত্রীদের সুবিধা হয়। এমনকি মুঘল শাসকরা মেলার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাও নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ধর্মীয় শোভাযাত্রা বা রাম নবমীর মতো উৎসবগুলোর ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হয়েছে। গবেষণা বলছে, কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় উসকানিমূলক স্লোগান দিতে যাচ্ছে, অস্ত্র হাতে মিছিল করছে এবং মসজিদের সামনে গিয়ে কেশরিয়া পতাকা টাঙিয়ে দিচ্ছে। এতে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে সংঘর্ষ বাধছে।

এরপর হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন এগুলোর বিরুদ্ধে নামে মাত্র ব্যবস্থা নিলেও মূল দোষীদের বিরুদ্ধে না গিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে। কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই গণগ্রেফতার করা হয়।

এছাড়া হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে শবরি ও হনুমান দেবতার প্রচার বাড়াচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে ভারতের আদিবাসী এলাকাগুলোতে খ্রিস্টানবিরোধী সহিংসতা বেড়েছে। একইসঙ্গে, ভিএইচপি ও আরএসএস সেখানে শবরি দেবীর পূজা জনপ্রিয় করতে কাজ করছে।

গুজরাটের ডাংস এলাকায় বিশাল ‘শবরি কুম্ভ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে একটি শবরি মন্দিরও তৈরি করা হয়েছে। শবরি ছিলেন এক দরিদ্র নারী, যিনি রামের জন্য বেল সংগ্রহ করতেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আদিবাসী সমাজকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বানানোর জন্য এই প্রচার চালাচ্ছে।

ভারতে ধর্মীয় উৎসব বরাবরই সামাজিক সম্প্রীতির মাধ্যম ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে কুম্ভ মেলার মতো বিশাল আয়োজনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্পষ্ট ছাপ পড়েছে।

এই প্রবণতা শুধু ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য হুমকি নয়, বরং দেশের সামগ্রিক সামাজিক বন্ধনকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার এ কৌশল ভবিষ্যতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

নিউজনেস্ট ডেস্ক
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত