গাজায় হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরায়েল। গত মঙ্গলবার থেকে নতুন করে হামলা শুরু করে দেশটি। এবার তারা গাজায় তিনটি প্রধান দিক থেকে স্থল অভিযানে নেমেছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় সূত্র ও সরকারি বিবৃতির বরাতে জানা গেছে, ইসরায়েলি বাহিনী তিনটি প্রধান পথে গাজায় প্রবেশ করেছে—মধ্য গাজার নেটজারিম করিডোর, দক্ষিণের রাফাহ শহরের শাবুরা শরণার্থী শিবির, এবং উত্তরের বেইত লাহিয়া শহরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল।
নেটজারিম করিডোর
গত বুধবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অভিচাই আদ্রি জানান, সেনারা মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরি করাসহ উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরির জন্য সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত স্থল অভিযান চালাচ্ছে।
আনাদোলুর এক প্রতিবেদক জানান, দখলদার ইসরায়েলি সেনারা পূর্ব দিক থেকে নেটসারিম করিডোরে প্রবেশ করে সালাহউদ্দিন সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে গেছে।
তবে তারা পশ্চিম দিকে বিস্তৃত হয়নি। বরং সাগর তীরবর্তী রাস্তা ‘আর রশিদ’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে চলাচল বন্ধ রেখেছে। এর ফলে গাজার উত্তর অংশ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নভেম্বর ২০২৩ সালে গাজায় হত্যাযজ্ঞের শুরুতে দখলদার ইসরায়েল নেটসারিম করিডোর তৈরি করে, যা গাজা ও উত্তরের অন্যান্য এলাকা থেকে মধ্য ও দক্ষিণ গাজাকে বিচ্ছিন্ন করে। করিডোরটি পূর্ব থেকে শুরু হয়ে সাগরের দিকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। পরে ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সেনারা এটি ছেড়ে দেয়।
এদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যে গাজাবাসীদের উত্তর থেকে দক্ষিণে যাতায়াতের সুযোগ দিতে নেটজারিম করিডোর খুলে দেওয়া ও ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল। কিন্তু ইসরায়েল বারবার এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে । অবশেষে গত মঙ্গলবার থেকে সেখানে আবারও যুদ্ধ শুরু করেছে।
রাফাহ আক্রমণ
মধ্য গাজায় স্থল অভিযান চালানোর পাশাপাশি রাফাহ শহরের ‘ফিলাডেলফিয়া করিডোর’ ব্যবহার করে সেনা পাঠিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। তাদের দাবি, তারা রাফাহ শহরের শাবুরা এলাকায় প্রবেশ করে বেশ কয়েকটি স্থাপনা ধ্বংস করেছে।
আনাদোলুর প্রতিবেদক জানান, ফিলাডেলফিয়া করিডোর দিয়ে গাজার এক-তৃতীয়াংশ অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। তবে শাবুরা এলাকায় সামরিক তৎপরতা সীমিত রয়েছে।
বুধবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, ‘গাজাবাসীদের আরও কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে, সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।’
এই নতুন হামলায় গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দখলদার ইসরায়েল ৫৯১ জন ফিলিস্তিনিকে শহিদ করেছে, এতে আহত হয়েছেন আরো ১ হাজার ৪২ জন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু!
বেইত লাহিয়া আক্রমণ
গত বৃহস্পতিবার দখলদার ইসরায়েল উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় তৃতীয় দফা স্থল অভিযান শুরু করে। একইসাথে বিমান হামলাও চালানো হয়। এদিকে গতকাল শুক্রবার সকালে ইসরায়েলি সামরিক যান সীমিত পরিসরে বেইত লাহিয়ায় ঢুকে এবং গোলাবর্ষণ করে।
আনাদোলুর প্রতিবেদক জানান, সেনারা শহরের মূল অংশে প্রবেশ করেনি, বরং ইসরায়েল যে নিরাপত্তা করিডোর তৈরি করেছে, তার ভেতরেই অবস্থান নিয়েছে। এই হামলার কারণে শহরজুড়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং বহু বাসিন্দা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
উত্তর গাজার বেশিরভাগ অংশ ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যারা এলাকা ছাড়েননি, তারা অবরোধের কারণে অভাব ও অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বাহিনীর জবাব
তিনটি মূল ফ্রন্টে ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থানের পরও এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ হয়নি। তবে গত বৃহস্পতিবার হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেড ঘোষণা দেয়, তারা ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবে নয়টি রকেট হামলা চালিয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১ মার্চ যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হয়। ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল গাজার যুদ্ধ বন্ধ রাখবে এবং বন্দি বিনিময় করবে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
নেতানিয়াহু চেয়েছিলেন, যুদ্ধবিরতি বা সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই হামাসের থেকে আরও বেশি বন্দি মুক্ত করিয়ে নিতে। ফলশ্রুতিতে হামাস দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়নে রাজি হয়নি। কারণ, তারা পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ও ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার দাবি করে আসছিল।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় অব্যাহতভাবে গণহত্যা চালিয়ে আসছে। চলমান এ হত্যাযজ্ঞে এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ১ লাখ ৬২ হাজারের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু!
গাজায় আরও ১৪ হাজারের বেশি মানুষ এখনো নিখোঁজ। অনেকেরই ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানা যায়নি। গাজায় নতুন করে ইসরায়েলের স্থল অভিযানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে, যেখানে হাজারো নিরীহ ফিলিস্তিনি জীবন হারাচ্ছেন।
সূত্র: এএ







