ভারতের লোকসভায় গত ৩রা এপ্রিল ওয়াকফ সংশোধন বিল পাস হয়। এরপর থেকেই ভারতীয় মুসলিমদের সম্পত্তির অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা আবারও মূলধারার আলোচনায় এসেছে। প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের পর এই বিল পাস হয়। ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক ওয়াকফ আইনে পরিবর্তন এনে বিলটি অনেক বিতর্কিত ধারা প্রস্তাব করেছে। সবাই বলছেন, এই পরিবর্তন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগজনক!
উপস্থাপিত সংশোধনীগুলো বহুদিন ধরে মুসলিম মালিকানাধীন ধর্মীয় সম্পত্তি কব্জার জন্য চলা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে আরও জোরালো করেছে। ডানপন্থী সংগঠন ও তাদের সহযোগীরা নানা প্রচারণা, দাবি এবং আইটি সেল থেকে তৈরি কনটেন্টের মাধ্যমে ওয়াকফের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যেমন, কর্ণাটকে সম্প্রতি প্রায় ৪০টি ওয়াকফ সম্পত্তি—যার মধ্যে কবরস্থান, হ্রদ ও কৃষিজমি রয়েছে—সরকারি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহ ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল, শত শত ওয়াকফ সম্পত্তি দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ), সরকারি মালিকানাধীন সম্পত্তি এবং ভূমি উন্নয়ন অফিসের আওতায় পড়ে।
এই সংশোধনী বিল ডানপন্থী গোষ্ঠী এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের দাবি ও হস্তক্ষেপকে আইনত বৈধতা দিয়েছে। একই সাথে মুসলিম ধর্মীয় সম্পত্তির ওপর তাদের দখলদারির জন্য শক্তিশালী আইনি অস্ত্রও তুলে দিয়েছে।
ওয়াকফের উদ্দেশ্য বিনষ্ট করার ক্ষতিকর দিকগুলো
‘ওয়াকফ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুদান। বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ৮ লাখ ৭০ হাজারের মতো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৩ হাজার সম্পত্তি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্য বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
ওয়াকফ সম্পত্তি মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের দানকৃত সম্পদ, যা মাদরাসা, মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল বা কবরস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই সম্পত্তি বিক্রি, উপহার, বন্ধক বা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তর করা যায় না এবং বাইরের কোন প্রভাব এতে কাজ করার কথা নয়। অথচ নতুন পাস হওয়া বিল অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার সার্ভে অফিসার নিয়োগ করবে। যারা এসব সম্পত্তি পরিদর্শন করতে পারবে।
মুসলিমদের আশঙ্কা, এই বিধান ডানপন্থী চাহিদা পূরণের জন্য একটি হাতিয়ার হয়ে উঠবে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটাতে পারে। পুরোনো বা ঐতিহাসিক ওয়াকফ সম্পত্তির নথিপত্রের ঘাটতি এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। পাশাপাশি এটি সংখ্যাগরিষ্ঠের নীতির পক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার নতুন সম্পত্তি নিবন্ধন বা বাদ দিতে পারবে। ওয়াকফের হিসাব-নিকাশ ও কার্যক্রম প্রকাশ করার বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারবে।
বিল অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ডে দুইজন অ-মুসলিম সদস্য এবং নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে কর্মীদের মতে, মুসলিম নারীর ক্ষমতায়ন বা আইনি সহায়তার মতো দাবি আসলে ভুয়া প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। এসব দাবি সম্প্রদায়কে দুর্বল ও বঞ্চিত করার ছলনা মাত্র, যেখানে স্বচ্ছতা, অখণ্ডতা, অন্তর্ভুক্তি এবং আধুনিকায়নের কথা বলা হলেও উদ্দেশ্য ভিন্ন। বোর্ডের গঠন ও ‘মুতাওয়াল্লি’দের ক্ষমতা খর্ব করার মাধ্যমে বিজেপি ওয়াকফের কর্তৃত্ব কমিয়ে মুসলিম সম্পত্তি রক্ষার সুযোগ সীমিত করতে চায়।
ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারায় বোর্ড একটি সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখত। কিন্তু নতুন বিলে এই ক্ষমতা বাতিল করা হয়েছে। আগে তিনটি পদ্ধতিতে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করা যেত: ঘোষণা, ব্যবহারিক ওয়াকফ (ওয়াকফ বাই ইউজার) এবং ওয়াকফ আলাল আউলাদ। নতুন পরিবর্তনে এসব পদ্ধতি সংকুচিত করে শুধুমাত্র ঘোষণার মাধ্যমটিই রাখা হয়েছে। সেটাও কঠোর শর্তসাপেক্ষ। এখন কোন সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণার জন্য সংশ্লিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিকে কমপক্ষে পাঁচ বছর ইসলাম পালনের প্রমাণ দিতে হবে। এদিকে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সম্পত্তির ধর্মীয় ব্যবহারের ভিত্তিতে ওয়াকফ ঘোষণা করা যেত। এই পরিবর্তনগুলো বিভ্রান্তি ও জটিলতা সৃষ্টি করবে, যা মুসলিম পরিচয়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শনের সুযোগ এনে দিতে পারে।
এই বিতর্কিত বিধানগুলো মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তির অধিকার সীমিত করে এবং বৃহত্তর একটি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে পুরো সম্প্রদায়কে তথাকথিত আইনসম্মত পদ্ধতিতে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’-এর মর্যাদায় ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বৈষম্যমূলক ও মুসলিমবিরোধী সংশোধনী
২০২৩ সালের আগস্টে সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করা হয়। প্রবল বিরোধিতার মুখে পরে এটি সংসদের যৌথ কমিটির (জেপিসি) কাছে পাঠানো হয়। তবে এই কমিটির কার্যক্রম নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। জেপিসির সদস্য ড. মোহাম্মদ জাভেদ অভিযোগ করেন, কমিটি প্রকৃত ধারা অনুযায়ী আলোচনা করেনি। এমনকি বিতর্কিত ধারাগুলোকেও ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে।
গত এপ্রিলের ১ তারিখে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড এই সংশোধনী আইনটির তীব্র সমালোচনা করে। বোর্ড জানায়, এই সংশোধনীগুলো মুসলিম সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার ধ্বংস করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বোর্ড বলে, ‘নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির বিষাক্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।’
লোকসভায় বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৮৮ জন সংসদ সদস্য। যার মধ্যে সরকার সমর্থিত জোটও রয়েছে। কিন্তু তাদের এখন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। ২৩২ জন সংসদ সদস্য ও সংখ্যালঘু অধিকারকর্মীরা এই বিলের বিরোধিতা করছেন। বহুদিন ধরেই মুসলিম নেতারা এই বিলকে বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী বলে আসছেন। এই বিল নিয়ে আওয়ামী ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি প্রশ্ন তোলেন, ‘ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করলে আগে ২ বছরের শাস্তি ছিল, সেটা কমিয়ে কেন ৬ মাস করা হলো? মুসলিমদের অপমান করাই কি এই বিলের একমাত্র উদ্দেশ্য?’
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও বিলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিমরা তো মন্দির কমিটির কার্যক্রমে অংশ নেন না। তাহলে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের রাখা কেন? এটা মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ।’ তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই বিল একতরফাভাবে আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় লোক দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাকি গোহরি এই বিলের পক্ষে দলের ভূমিকার কারণে পদত্যাগ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের বিষয়ে দলের অন্যায় আচরণ আমাকে ও আমার সম্প্রদায়কে নিঃস্ব করেছে।
কাইরানা আসনের সাংসদ ইকরা হাসান বলেন, ‘এই সংশোধনী থেকে মুসলিম নারীরা কিছুই পাবেন না। বরং তাঁদের শুধুই নামমাত্র দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।’
প্রধান বিরোধী দল ও মুসলিম অধিকারকর্মীরা এখন সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা এই ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ করবেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এই বিলের পেছনে গঠনমূলক কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যদি সরকার সত্যিই মুসলিম নারীদের বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ চাইত, তাহলে অপরাধ, গণধর্ষণ, কিংবা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হামলার ঘটনা বিগত কয়েক বছরে বেড়েছে। এই সংশোধনীতে মুসলিম নারীদের শুধুই প্রতীকী দেখানো হয়েছে। মূলত, মুসলিমদের দুর্বল করার লক্ষ্যেই এই আইন প্রণীত হয়েছে।
উসকানি তৈরির পাঁয়তারা?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়াকফ সংশোধনী বিলের প্রভাব আসলে অনুমানের চেয়ে অনেক গভীর। কারণ, ইতিহাস বিকৃতিকারী কিছু গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই মুসলিম ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ধর্মীয় সম্পত্তি নিয়ে অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছে। নতুন এই সংশোধনীগুলো হিন্দুত্ববাদীদের জন্য মুসলিমদের আরও হেয় করার সুযোগ করে দেবে।
এছাড়া এই আইনে জনসম্পৃক্ততা ছিল না বললেই চলে। জেপিসির সদস্য মোহাম্মদ জাভেদ ও অরবিন্দ গণপত সাওয়ান্ত জানান, ওয়াকফ বিষয়ক মতামত জানাতে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি ও তিন শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাদের নিজের মত প্রকাশের জন্য কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় দেওয়া হয়নি। বিতর্কিত ধারা, উপস্থাপনা, আলোচনা এবং ভোটাভুটির পুরো প্রক্রিয়াটিই পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের মতামত উপেক্ষা করার জন্য সাজানো হয়েছে।
এই বিলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তাই খুবই যৌক্তিক ও জরুরি। কারণ সংশোধনীগুলো সরাসরি মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে আঘাত হেনেছে। যা সরকারের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই বিল ঘৃণা ছড়ানো গোষ্ঠীর জন্য মুসলিমদের ওপর হামলা চালানোর নতুন অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের সহিংসতা কিংবা সম্প্রতি সাম্ভলে হওয়া দাঙ্গা—প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলিম ধর্মীয় সম্পত্তিকে কেন্দ্র করেই উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছে। বিজেপি সরকার যেন সেই পথেই এগোচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুদের দমন করার জন্য তারা ব্যবস্থাপনা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র: এমএম







