নিউজনেস্ট

মাদকের বিকল্প আফগানের জাফরান উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিশ্ব রেকর্ডের গল্প

মাদকের বিকল্প আফগানের জাফরানের উৎপাদন ও রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড
মাদকের বিকল্প আফগানের জাফরানের উৎপাদন ও রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড। ছবি: সংগৃহীত

গত কয়েক মাসে আফগানিস্তানে জাফরানের উৎপাদনে এক বড় ধরনের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে সরকারের ব্যাপক সহায়তার পরিপ্রেক্ষিতে এই অগ্রগতি অর্জন হয়েছে।

আফগানিস্তান জাফরান ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১২ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৪০ টনেরও বেশি জাফরান উৎপাদিত হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় একটি বড় প্রবৃদ্ধি।

আফগানিস্তান জাফরান ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল ওয়াহিদ সাদাত ‘হুররিয়াত রেডিও’কে জানান, বর্তমানে দেশের ২৬টি প্রদেশে জাফরান চাষ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইউনিয়নটি পুরো আফগানিস্তানে এর চাষ আরও বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানজুড়ে এই বছরে ১০.৫ হাজার একর জমিতে জাফরান চাষ করা হয়েছে।

আফগানিস্তান জাফরান ইউনিয়নের কর্মকর্তারা মনে করেন, জাফরানের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি, আফগান জাফরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, দীর্ঘমেয়াদী শুষ্কতা, চাহিদা বৃদ্ধি এবং ইসলামি ইমারতের মাদক চাষ, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ফলে কৃষকদের মধ্যে এই ফসল চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

এদিকে আফগানিস্তান জাফরান ইউনিয়ন ইসলামি ইমারতের পক্ষ থেকে জাফরান চাষীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এছাড়া সরকারের কাছে তাদের পণ্যের বিক্রির জন্য আরও সুযোগ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছে।

অপরদিকে খেসারির চাষ, যা আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদনের প্রধান উৎস। এটি বিক্রি ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারির পর আফগান কৃষকরা জাফরানকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি এই ফসলের চাষেও বড় ধরনের বৃদ্ধি ঘটেছে।

মাদকের বিকল্প আফগানের জাফরানের উৎপাদন ও রপ্তানির বিশ্ব রেকর্ডের গল্প
বিশ্বের অন্যতম দামী পণ্য হিসেবে পরিচিত ‘আফগান জাফরান’ মসলা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অন্যতম দামী পণ্য হিসেবে পরিচিত ‘আফগান জাফরান’ মসলা শিল্পে গুণমান ও উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে আফগান জাফরানপণ্য উজ্জ্বল সোনালী রঙ, সুগন্ধি ও অতুলনীয় স্বাদের জন্য বিশ্ব বাজারে একটি স্থায়ী জায়গা দখল করে রয়েছে।

এটি কেবল একটি মসলা নয়; বরং একটি বিশাল শিল্প, যা আফগান অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। গত দুই দশকে আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাফরান উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। আফগান জাফরান তার উচ্চ মানের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বজায় রেখেছে।

জাফরানের উচ্চমূল্যের কারণে জাফরানকে ‘লাল সোনা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শুধুমাত্র চমৎকার গুণমানের জন্যই আফগান জাফরান বিশ্বের অন্যতম সেরা জাফরান হিসেবে পরিচিত। এটি আফগান কৃষকদের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক অবদান হয়ে উঠেছ।

মাদক থেকে জাফরানের চাষাবাদ

আফগান জাফরানের উৎপাদনের শুরুটা হয়েছিল হেরাত অঞ্চলে। সেখানে এই মসলা উৎপাদনের প্রধান উৎসের ফুলগুলো জন্ম নেয়। সম্প্রতি আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাফরান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। পাশাপাশি এর উৎপাদনকারীরা সফলভাবে এই শিল্পে বিশেষ অর্জন লাভ করেছেন। ২০০৬ সালে আফগানিস্তানে প্রথম জাফরান চাষ শুরু হয়, যা মাদক উৎপাদন থেকে কৃষিকে সরিয়ে নিয়ে নতুন একটি পন্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়।

এই পরিবর্তন আফগান কৃষকদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে। এছাড়া দেশের অর্থনীতিতে একটি সুস্থ ও নিরাপদ বিকল্পের পথ সৃষ্টি করেছে। আফগানিস্তান এখন বিশ্বে জাফরান উৎপাদনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। তবে গুণমানে এটি প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

ইসলামি ইমারতের পক্ষ থেকে মাদক চাষ— বিশেষ করে আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করার পর কৃষকরা জাফরান চাষে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তন আফগান কৃষির অর্থনৈতিক উন্নতি এবং দেশের আইনসিদ্ধ ও নিরাপদ কৃষি চাষের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

এছাড়া মাদক চাষের ফলে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে এই পরিবর্তন একটি বড় ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে এসেছে।

আফগানিস্তানের জাফরান চাষের কেন্দ্র হেরাত

আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশ বর্তমানে জাফরান চাষের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মৃদু আবহাওয়া এবং উর্বর মাটি এই অঞ্চলের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। যেখানে জাফরান ফুলের চাষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে জাফরান সংগ্রহের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং দক্ষতার দাবি রাখে। যেখানে ফুল থেকে হাতে হাতে সুতা সংগ্রহ করে এর উচ্চমান নিশ্চিত করে এবং এর মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি করে।

জাফরান চাষে এক কেজি জাফরান উৎপাদনের জন্য প্রায় ১,৫০,০০০ ফুল প্রয়োজন। যা এই মসলাটির বিরলতা এবং উৎপাদনের কঠিন প্রক্রিয়াকে চিত্রিত করে। এই পরিশ্রমী প্রক্রিয়া জাফরানকে বিশ্বের অন্যতম দামি মসলায় পরিণত করে। পাশাপাশি এর প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধির ফলে আফগানিস্তানে এর উৎপাদন গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

২০২৪ সালে আফগানিস্তানে জাফরান উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪০ টনে, যা গত বছরের ৩০ টনের তুলনায় অনেক বেশি। এই বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সরকারের বিশেষ নজরদারি এবং কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি। আগামী বছরে আফগান জাফরানের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশ্ব বাজারে আফগান জাফরানের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। সৌদি আরব, ওমান, চীন, ভারত, ইউরোপ এবং আমেরিকা এই মসলার অন্যতম প্রধান গন্তব্য। শুধু খাদ্য শিল্পেই নয়, জাফরানকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রসাধনী এবং ঔষধী শিল্পেও, যা তার বাণিজ্যিক মূল্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তানে জাফরান চাষ অনেক আফগান নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে গ্রামীণ এলাকার জীবিকা উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে এবং দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে।

আফগান জাফরান এক সময় মাদক চাষের বিকল্প হিসেবে শুরু হলেও আজ তা একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক উপাদান হয়ে উঠেছে। এই মসলার মাধ্যমে হাজার হাজার কৃষক তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে, এবং আফগানিস্তানকে নতুন একটি বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হেরাতের সবুজ ক্ষেত থেকে শুরু হয়ে, আফগান জাফরান এখন পৃথিবীজুড়ে গুণ, মান এবং সম্ভাবনার প্রতীক।

শাহাদাত হুসাইন
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত