চীনের এক মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, ২০ মাস আগে গ্রেপ্তার হওয়া এক তরুণ উইঘুর সংগীতশিল্পী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। ‘চরমপন্থা উসকে দেওয়ার’ মিথ্যা অভিযোগে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
২৬ বছর বয়সী ইয়াশার শোহরেত একজন র্যাপার ও গীতিকার। ২০২২ সালে চীনে করোনার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হওয়া ‘সাদা কাগজ আন্দোলনে’ অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চেংদু শহর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।
মানবাধিকার সংগঠন ‘ওয়েইকুয়ানওয়াং’ (আইন-অধিকার সুরক্ষা নেটওয়ার্ক) জানায়, ২০২৪ সালের ২০ জুন ইয়াশারকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মিথ্যা অভিযোগটি ছিল, তিনি এমন গান লিখেছেন ও গেয়েছেন যা বিদ্রোহকে উস্কে দেয়। এছাড়া তার কাছে এমন কিছু বস্তু পাওয়া গেছে যা উগ্রপন্থার প্রচার করে। তিনি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও দ্বিতীয় দফায়ও আদালত আগের রায় বহাল রাখে। সাজা অনুযায়ী, তিনি ২০২৬ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত কারাগারে থাকবেন। বর্তমানে তাকে শিনজিয়াং অঞ্চলের উসু কারাগারে রাখা হয়েছে।
উসু কারাগার বা শিনজিয়াং প্রাদেশিক কারা প্রশাসনের দপ্তরে একাধিকবার ফোন করলেও কেউ সাড়া দেয়নি। এমনকি চীনের অনলাইন খোঁজার সাইটগুলোতেও ইয়াশারের গ্রেপ্তার, বিচার বা শাস্তির কোনো সরকারি রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
প্রবাসে থাকা এক উইঘুর তরুণ অধিকারকর্মী (নিরাপত্তার কারণে ছদ্মনামে ‘আমান’ নামে পরিচিত) বলেন, ‘আগে চীনা সরকার বড় বড় গ্রেপ্তার প্রকাশ্যে ঘটাত, এখন আর তা করে না। এখন মানুষকে চুপিচুপি ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা হয়—কোন অভিযোগপত্র, বিচার বা রায়ের ঘোষণা ছাড়াই।’
‘সাদা কাগজ আন্দোলন’ এর ইতিহাস
ইয়াশার শোহরেতের বাড়ি ছিল শিনজিয়াংয়ের বোলে শহরে। চীনের এই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ উইঘুর মুসলমান বাস করেন, যাদের দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের নিপীড়নের মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে শিনজিয়াংয়ের উরুমচি শহরের একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনা চীনের বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ধারণা করা হয়, কোভিড নিয়ন্ত্রণের নামে ভবনটিকে তালাবদ্ধ করে রাখায় বহু মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যান—তাদের বেশির ভাগই ছিলেন উইঘুর মুসলিম। সেই ঘটনার পর চীনের বহু শহরে হাজারো মানুষ রাস্তায় নামেন। সরকারবিরোধী স্লোগান না দিয়েও, প্রতিবাদকারীরা মুখে কিছু না বলে কেবল সাদা কাগজ উঁচিয়ে ধরে জানান দেন, তারা বাকরুদ্ধ—তাদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই।
ইয়াশার শোহরেত তখন উরুমচির নিহতদের স্মরণে উইঘুর ভাষায় একটি গান রচনা ও পরিবেশন করেন। এরপরই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ‘জনসমাগম ঘটিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নের’ অভিযোগে তাকে ২১ দিন আটক রাখা হয়। পরে অবশ্য তিনি ছাড়া পান।
চীনে ‘চরমপন্থা’ ছড়ানোর অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড পাওয়া উইঘুর তরুণ শিল্পী ইয়াশার শোহরেত মূলত তার গানের কথার জন্যই সরকারের নজরে পড়ে যান। মঞ্চে ‘উইগ্গা’ নামে পরিচিত এই শিল্পী ২০২৩ সালে একটি গান প্রকাশ করেন যার নাম ছিল ‘জেগে ওঠো’ (Wake Up)। এটি চীনের জনপ্রিয় সংগীত স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটইজ ক্লাউড মিউজিকে প্রকাশিত হয়েছিল।
গানটির কিছু অংশ ছিল এমন:
‘তারা চিতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কারা? একদল শিকারি…
আমি যখন জেগে উঠলাম,
চারপাশ আমাকে গভীর ভাবনায় ডুবিয়ে দিল।’
এই কথাগুলোর মধ্যে শিল্পী নিজেকে যেন এক শিকারে পরিণত হওয়া প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যাকে এক শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার পরিণতি আগেই ঠিক করা হয়ে গেছে—এমনটাই মত দিয়েছেন বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেসের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক পরিচালক সাওউত মুহাম্মদ।
তার মতে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) সম্ভবত এই কথাগুলোকে ‘হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ‘তাদের দৃষ্টিতে, উইঘুর ভাষার ওপর জোর দেওয়া মানেই উইঘুর জাতীয়তাবাদের উত্থান—যা শি জিনপিংয়ের ‘একচীন’ ধারণার বিরুদ্ধে যায়’—বলেন সাওউত।
তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালে শিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের গণআটকের পর থেকে বহু গীতিকার, কবি, লেখক ও পণ্ডিতদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের অনেককেই ‘রাজনীতি ঢুকিয়ে’ শিল্পচর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। যদিও চীনের সংবিধানে মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার রয়েছে, কিন্তু ২০০০ সালের পর চালু হওয়া দ্বিভাষিক শিক্ষানীতির মাধ্যমে উইঘুর শিশুদের মান্দারিন ভাষা শেখানো বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয় এবং উইঘুর ভাষা ধীরে ধীরে দমন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চীনা রাজনৈতিক বিশ্লেষক গং জি শেন জানান, ইয়াশারের গান সরাসরি কোন রাজনৈতিক বক্তব্য দেয় না, বরং তা একজন মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আবেগের কথা বলে। তিনি বলেন, ‘সাদা কাগজ আন্দোলনের সময় ইয়াশার খুব বেশি সামনের সারিতে ছিলেন না। তবে বেইজিং কোন ধরনের ভিন্নমত বা সন্দেহজনক ইঙ্গিতও সহ্য করতে পারে না। তাই তাকে ‘চরমপন্থার’ অভিযোগে এমন কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতিগোষ্ঠীর কাউকে দেওয়া হতো না।’
এই পুরো ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—চীন সরকারের চোখে উইঘুরদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভাষা ও শিল্পচর্চাও ‘সন্দেহের’ জায়গা এবং একটু ভিন্নস্বরে কথা বললেই তাদের ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করে নির্মম শাস্তি দেওয়া হয়।
সূত্র: আরএফএ







