মুর্শিদাবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস হামলা-লুটপাট, গৃহহীন ও আতঙ্কিত বাসিন্দারা

মুর্শিদাবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস হামলা-লুটপাট, গৃহহীন ও আতঙ্কিত বাসিন্দারা
মুর্শিদাবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস হামলা-লুটপাট, গৃহহীন ও আতঙ্কিত বাসিন্দারা। ছবি: সংগৃহীত

গত ১১ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর এলাকায় সহিংস এক দাঙ্গার পর বেদবুনা গ্রামের বাসিন্দারা এখন ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনবিরোধী এক প্রতিবাদের সময় বাইরের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের একদল দুষ্কৃতকারী হঠাৎ গ্রামে হামলা চালিয়ে ১২০টি খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। লুটপাট করে নেয় নগদ টাকা, গয়নাগাটি এমনকি গবাদি পশুও। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক।

এই ভয়াল দিনের কথা স্মরণ করে গ্রামের বাসিন্দা রাহুল মন্ডল বলেন, ‘তাদের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র আর পাথর। ওরা আমাদের ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বাঁচি।’ সেই দিনের ভয় তার মুখে আজও স্পষ্ট। তিনি বলেন, শুধু ঘরবাড়ি নয়, তারা গবাদি পশুও নিয়ে গেছে।

আরেক বাসিন্দা নীলিমা বলেন, ‘আমরা একটু দূরে লুকিয়ে ছিলাম। পরে ফিরে এসে দেখি, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘর, জিনিসপত্র কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’ গ্রামজুড়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে পড়ায় শতাধিক পরিবার, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল, আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়।

তপন নস্কর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ’পুলিশকে আমরা সাথে সাথেই জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা প্রায় দুই ঘণ্টা পরে এসে পৌঁছে।’ এখন অনেক গ্রামবাসী ভিটেমাটি হারিয়ে কেউ মালদা জেলার ভগীরথী নদীর ওপারে, আবার কেউ প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডে আত্মীয়দের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

শান্তি নামের এক নারী—যিনি এখন আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন, তিনি বলেন, আমরা এতদিন ধরে অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিলাম। কখনো এমন কিছু ঘটবে ভাবিনি।’ তার কথায় ধরা পড়েছে বিশ্বাসঘাতকতা ও হতভম্বতার ব্যথা। যা এখন পুরো গ্রামবাসীর অনুভূতিতেই বাসা বেধেছে।

জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হবে। এই কাজ রাজ্য সরকারের অর্থায়নে যুদ্ধকালীন তৎপরতার শিকারদের মাঝে চালানো হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

এদিকে একই জেলায় ধুলিয়ানে আরেকটি দাঙ্গাপীড়িত এলাকা থেকেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরছে। সেখানকার স্থানীয় ফার্মাসিস্ট রাজেশ বলেন, ‘প্রশাসন ও বিএসএফ টহলের আশ্বাসে দোকান খুলেছি। এটাই আমার একমাত্র রোজগারের উৎস।’ তিনি জানান, পাঁচ দশক ধরে এই এলাকায় আছেন। কখনো ভাবেননি এমন ভয়াবহতা দেখবেন।

মো. আকবর, যার দোকানও ভাঙচুর করা হয়েছে, বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। এরা কোনো প্রতিবাদকারী ছিল না; এরা ছিল দুষ্কৃতকারী।’ তিনি জানান, এলাকাটিতে বহু বছর ধরে সম্প্রীতি বজায় ছিল। তিনি এই অশান্তির জন্য বাইরের লোকজনকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, ’আমরা শুধু শান্তি আর নিরাপত্তা চাই।’

এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাসিন্দারা পড়েছেন নতুন বিপদে। কেননা সেখানে নিষিদ্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা আর খালি এটিএম। ধুলিয়ানের বাসিন্দা পঙ্কজ সরকার বলেন, ‘কোনও এটিএমে টাকা নেই। আবার ডিজিটাল পেমেন্টও করতে পারছি না। জানি না কীভাবে চলব।’

যদিও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন—বিচার, সহায়তা আর সবচেয়ে বড়ো কথা শান্তি ফিরে পাওয়ার জন্য।

আমাদের ফলো করুন