ওয়াক্ফ (সংশোধন) আইন ২০২৫–এর কয়েকটি বিতর্কিত ধারা আপাতত কার্যকর করা হবে না বলে সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ওয়াক্ফ বোর্ড ও কাউন্সিলে অ-মুসলিম সদস্য নিয়োগ। এছাড়াও রয়েছে ইতোমধ্যে আদালত ঘোষিত ওয়াক্ফ সম্পত্তি ডি-নোটিফাই করার বিধান।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ—যার বাকি দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি পি.ভি. সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি কে.ভি. বিশ্বনাথন—সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার দেওয়া এই আশ্বাস রেকর্ড করে। তিনি জানান, সংশোধিত আইনের আওতায় কোনও নিয়োগ বা পরিবর্তন আপাতত হচ্ছে না। এছাড়া যেসব সম্পত্তিকে ওয়াক্ফ হিসেবে আদালতের স্বীকৃতি রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও অপরিবর্তিত থাকবে।
আদালত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, আইনটির বৈধতা নিয়ে দায়ের করা রিটগুলোর জবাব সাত দিনের মধ্যে দিতেই হবে। এরপর মামলাকারীরা পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের পাল্টা বক্তব্য জমা দিতে পারবেন। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৫ মে। যেখানে কেবল দিকনির্দেশনা ও অন্তর্বর্তী আদেশ নিয়ে আলোচনা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৩ই এপ্রিল লোকসভা এবং ৪ই এপ্রিল রাজ্যসভায় পাশ হওয়া এই সংশোধনী আইন ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। ১৯৯৫ সালের ওয়াক্ফ আইনের এই সংশোধনীর ফলে ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আসার কথা ছিল।
তবে নতুন আইনটি ঘিরে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলে তীব্র আপত্তি উঠেছে। কংগ্রেস সাংসদ মোহাম্মদ জাভেদ ও এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি–সহ একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন আইনটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিট দায়ের করেছেন। তাদের অভিযোগ, এই আইন মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং সংবিধানে স্বীকৃত ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন করছে।
সবচেয়ে বিতর্কিত ধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ইউজার ভিত্তিক ওয়াক্ফ’ এর সংজ্ঞা থেকে বাদ পড়া। এতে বহু প্রাচীন মসজিদ, কবরস্থান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্পত্তি প্রভাবিত হতে পারে যেগুলোর কোনও আনুষ্ঠানিক দলিল নেই। মামলাকারীরা বলেন, ‘এ ধরনের অনেক স্থাপনা ব্রিটিশ আমলের আগের। যখন এমন কোনও রেজিস্ট্রেশন প্রথা ছিল না। তাহলে এগুলোর রেজিষ্ট্রেশন হবে কি করে?’
শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি জামা মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এসব জায়গায় দলিল থাকবে কী করে? ওগুলো তো শত শত বছর পুরনো।’
অন্যদিকে ওয়াক্ফ বোর্ড ও কাউন্সিলে অ-মুসলিম নিয়োগ সংক্রান্ত ধারাটি নিয়েও আদালতে তীব্র প্রশ্ন উঠে। এসজি তুষার মেহতা এ নিয়ে যুক্তি দিলেও, প্রধান বিচারপতি পাল্টা বলেন, ‘তাহলে কি মুসলিমদের হিন্দু ধর্মীয় বোর্ডে নিয়োগ দেওয়া হবে?’ এরপর তিনি চুপ হয়ে যান। বিচারপতি আরও বলেন, ‘বিচারকরা তাদের ধর্ম বিশ্বাস কোর্টরুমে নিয়ে আসবেন না; বরং তা বাইরে রেখে আসবেন।’
আদালত আরও একধারার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে আদালত ঘোষিত ওয়াক্ফ সম্পত্তিকেও সরকার ডি-নোটিফাই করতে পারবে। সোজাসাপ্টা মন্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি অতীতকে মুছে ফেলতে পারেন না।’
মামলাকারীদের পক্ষে প্রবীণ আইনজীবীরা—কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিংভি, সি ইউ সিং এবং রাজীব ধাওয়ান—যুক্তি তুলে ধরেন। এই সংশোধনীগুলো মৌলিক অধিকার এবং সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী রায়গুলোর পরিপন্থী। বিশেষ করে অযোধ্যা মামলার রায়ে ঘোষিত নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তারা আরও চ্যালেঞ্জ করেন সেই বিধান, যেখানে বলা হয়েছে, কেউ ওয়াক্ফ তৈরি করতে চাইলে অন্তত পাঁচ বছর ধরে মুসলিম হতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিটি ওয়াক্ফ সম্পত্তির বাধ্যতামূলক নিবন্ধনও অনেক ঐতিহাসিক সম্পত্তিকে অকার্যকর করে দিতে পারে।
সলিসিটর জেনারেল দাবি করেন, এই সংশোধনী দীর্ঘ আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর এসেছে এবং রেজিস্ট্রেশনের শর্ত নতুন নয়, আগের আইনেও ছিল।
তবে বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, আইনটির ভালো দিক থাকলেও বর্তমানে যেসব সম্পত্তি ওয়াক্ফ হিসেবে স্বীকৃত, তাদের স্থিতি যেন কোনওভাবেই বিঘ্নিত না হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।
সরকারও জানিয়ে দিয়েছে, ৫ মে’র শুনানির আগে কোনও নতুন নিয়োগ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য পর্যায়ে করা হবে না। যদি মাঝপথে কোনও নিয়োগ হয়, তাহলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
সূত্র: এমএম







