২০২১ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক মহলে তালেবানকে ‘অবৈধ শাসক’ বলে এড়িয়ে চলা হয়েছিল। তবে সময়ের ব্যবধানে বদলে যাচ্ছে চিত্র। কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠী এখন একের পর এক কূটনৈতিক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে, বাড়ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন।
গত সপ্তাহে কাবুল সফর করেছেন আফগানিস্তানে ভারতের বিশেষ দূত আনন্দ প্রকাশ। তিনি তালেবান সরকারের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে বৈঠক করেছেন। একই সময়ে, তালেবান প্রতিনিধিরা উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বখতিয়র সাইদভের সঙ্গে প্রস্তাবিত ট্রান্স-আফগান রেল প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চালান।
এদিকে রাশিয়াও তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে। ২ মে রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্তিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মস্কোর আফগানিস্তান-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি জমির কাবুলভ জানান, আফগানিস্তানে আইএসআইএস-খোরাসান বিরোধী লড়াইয়ে তালেবানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে প্রস্তুত রাশিয়া।
২০২৪ সালের মার্চে মস্কোর কাছে একটি কনসার্ট হলে ভয়াবহ হামলায় ১৪৫ জন নিহত হওয়ার পর রাশিয়ার নিরাপত্তা নীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। দেশটি এখন তালেবানকে সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগী হিসেবে দেখছে। এমনকি সম্প্রতি তালেবানকে তাদের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকেও বাদ দিয়েছে মস্কো। যদিও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো দেয়নি, তবে তাদের কার্যকলাপ সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।
অর্থনৈতিকভাবে আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রহও বাড়ছে। বিশেষ করে খনিজ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে তারা আগ্রহী। ২০২৫ সালের মে মাসে রাশিয়ার কাজান শহরে অনুষ্ঠেয় এক ফোরামে তালেবান ও রাশিয়া মিলে ৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার এলপিজি (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) স্থানান্তরের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই গ্যাস সরবরাহ করা হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে।
চীন ইতিমধ্যেই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তালেবান নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের আওতায় আফগানিস্তানে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের আলোচনাও চলছে।
যদিও এখনো বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে চীন, রাশিয়া, ভারত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক বলছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে তালেবান।
পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের টানাপোড়েন
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে দক্ষিণ প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। ইসলামাবাদ সরাসরি অভিযোগ করছে, তালেবান সরকার তাদের দেশে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে। এই অভিযোগের পটভূমিতে ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা ৫৪ জন যোদ্ধাকে হত্যা করার দাবি করেছে।
তালেবান শাসন শুরুর পর থেকেই আফগান-পাক সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় উদ্বেগ। সম্প্রতি, সন্ত্রাসবাদ এবং মাদক চোরাচালানের অভিযোগে পাকিস্তান প্রায় ১ লাখ আফগান শরণার্থীকে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে ২২ এপ্রিল ভারতের কাশ্মীরে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টার মধ্যে থাকা পাকিস্তানের জন্য এটি একটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে নারী ও সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তারা ছিল সবচেয়ে সমালোচনামূলক।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে কিছু নীতিগত পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। খামা প্রেসের তথ্যমতে, ব্রিটেনের সরকার মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা কাতারে অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে ‘সীমিত ও বাস্তবসম্মত’6 যোগাযোগ বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করছে।
জার্মানিতেও তালেবান নিয়ে অবস্থান নমনীয় হচ্ছে। নতুন নির্বাচিত চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ আফগান শরণার্থীদের নির্বাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। জার্মান পার্লামেন্টে পররাষ্ট্র নীতির মুখপাত্র জুয়েরগেন হার্ড্ট স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সত্য হলো—তারা এখন ক্ষমতায় আছে।’
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানের সঙ্গে নির্দিষ্ট বিষয়ে সরাসরি আলোচনা করছে। গত মাসে মার্কিন কর্মকর্তারা কাবুল সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে। এর বিনিময়ে, তালেবানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের আরও তিন নেতার ওপর ঘোষিত পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয় ওয়াশিংটন।
এই ঘটনাগুলোই ইঙ্গিত দেয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে তালেবান সরকারের প্রতি পূর্বের কঠোর অবস্থান কিছুটা হলেও নরম হচ্ছে। একদিকে যেমন এখনও তারা বৈধ স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে বাস্তব রাজনীতির কারণে ধীরে ধীরে বিশ্ব পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিচ্ছে আফগান তালেবান সরকার।
সংকটের মাঝেও উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছে তালেবান
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালেবান শাসিত আফগানিস্তান দশটির অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালেবান সরকার রপ্তানি বাড়ানো, সরকারি রাজস্ব আদায়ে শৃঙ্খলা আনা এবং মুদ্রার মান রক্ষা করার মতো কিছু কার্যকর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্রাসেলসভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর বিশ্লেষক গ্রেইম স্মিথ তার এক প্রতিবেদনে জানান, তালেবান ডলারের লেনদেন নিষিদ্ধ করে ও কিছু আর্থিক নিয়ন্ত্রণ জারি করে আফগান মুদ্রার পতন ঠেকাতে সক্ষম হয়।
তালেবান সরকার সীমান্ত শুল্ক ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপ করে এবং নিয়মিত কর আদায়ের ওপর জোর দেয়, যা সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, যা আফগানিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। হেরাত উপত্যকায় ১৫টি সেচ খালের ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়েছে এবং নতুন করে আরও ৬টি খাল নির্মাণের কাজ চলছে।
তালেবান সরকার কৃষি ও নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। ছোট ছোট অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে গ্রামীণ এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো তুলনামূলকভাবে কম খরচে সম্পন্ন করা সম্ভব হওয়ায়, সেগুলো বাস্তবায়নে সুবিধা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতেও তালেবান সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ও টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
তাহিলরোজ নামের একটি আফগান সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, আফগানিস্তান লিথিয়াম, তামা, লোহা ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এই সম্পদ কাজে লাগাতে তালেবান সরকার অভ্যন্তরীণভাবে কিছু চুক্তি করেছে এবং বিদেশি কোম্পানির সাথেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
যদিও কিছু ইতিবাচক অর্থনৈতিক অগ্রগতি চোখে পড়ছে, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে তালেবান সরকারকে এখনও বড় পথ পাড়ি দিতে হবে। কৌশলগত অবস্থান ও খনিজ সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন করাই তালেবান সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র: এমএম