পেহেলগামে হামলার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যে উত্তেজনার সূচনা হয়েছিল, তা মঙ্গলবার দিবাগত রাতে নতুন এক মোড় নেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের অন্তত ৯টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পৌঁছে গেছে চরম উত্তেজনার দ্বারপ্রান্তে।
ভারতের দাবি, হামলার লক্ষ্য ছিল সেইসব ঘাঁটি, যেখান থেকে ভারতের বিরুদ্ধে বড়সড় জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা হচ্ছিল। ভারতীয় সেনা সূত্র বলছে, পেহেলগামের হামলার পাশাপাশি মুম্বাইয়ে অতীতের জঙ্গি হামলার প্রতিশোধ হিসেবেও এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান পুরো ঘটনাটিকে ‘সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ বলেন, ‘এই হামলা একটি আক্রমণাত্মক আগ্রাসন। পাকিস্তান তার জবাব দেবে।তবে কোথায়, কখন ও কীভাবে জবাব দেওয়া হবে, সেটা পাকিস্তানই ঠিক করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। তবে যদি বাধ্য করা হয়, তাহলে আত্মরক্ষার জন্য সবরকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ছে উদ্বেগ। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ একাধিক প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সংগঠন দুই দেশকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ওয়াশিংটনে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, ‘আমরা ঘটনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এটি একটি চলমান স্পর্শকাতর পরিস্থিতি।’
তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র কেবল পর্যবেক্ষক নয়, বরং ভারত ও পাকিস্তান—উভয়ের সঙ্গেই বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় যোগাযোগ রাখছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, এই সংকট যেন আরও না বাড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য দুই দেশকেই দায়িত্বশীল পথে এগোতে হবে।’
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘ভারতের এই হামলা লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। আমি শুধু চাই, দ্রুত এই সংঘাতের অবসান হোক।’
পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সামাজিক মাধ্যমে এক্স-এ এক পোস্টে প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে লেখেন, ‘আমরাও চাই, এই উত্তেজনার দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ অবসান ঘটুক।’
রুবিও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলও ভারতের ও পাকিস্তানের নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখছে এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী জোনাথন রেনল্ডস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেরই বন্ধু। সংঘাত নয়, স্থিতিশীলতা ও সংলাপের পথে যদি তারা যেতে চায়, তাহলে আমাদের সমর্থন পাবে।’
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘর্ষে সবচেয়ে দৃঢ় ও সতর্ক বার্তা এসেছে জাতিসংঘ থেকে। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়ে দিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সামরিক অভিযানে তিনি ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’।
জাতিসংঘের মুখপাত্র বলেন, ‘এই দুই দেশের সামরিক সংঘর্ষ বিশ্বশান্তির জন্য মারাত্মক হুমকি। এর ভার বিশ্ব সমাজ বহন করতে পারবে না।’ গুতেরেসের আহ্বান, সর্বোচ্চ সংযমই এখন একমাত্র পথ।
চীনের প্রতিক্রিয়া
চীনের বক্তব্যে স্পষ্ট এক ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক অবস্থান দেখা গেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ভারত ও পাকিস্তান এমন দুই প্রতিবেশী, যাদের ভাগ করা ইতিহাস, ভূগোল এবং ভবিষ্যৎ একসূত্রে গাঁথা।
মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেছেন, ‘আমরা চাই পরিস্থিতি যেন আরও জটিল না হয়। প্রয়োজনে চীন মধ্যস্থতার ভূমিকা নিতে প্রস্তুত।’ চীন আরও বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও তারা এই ইস্যুতে সমন্বয় করে চলবে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
পুতিন প্রশাসন দুই পক্ষের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে, ‘চলমান উত্তেজনা একমাত্র কূটনৈতিক উপায়েই নিরসন সম্ভব।’মস্কোর ভাষায়, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা রাশিয়ারও উদ্বেগের বিষয়।
জাপানের প্রতিক্রিয়া
জাপানের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হায়াশি সতর্ক করে বলেছেন, ‘গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে হামলার পর বর্তমান পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক। প্রতিশোধ আর পাল্টা প্রতিশোধের ঘূর্ণাবর্তে দুই দেশই সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।’
তিনি দুই দেশকে সংলাপ ও সংযমের পথ বেছে নিতে আহ্বান জানান।
ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্স বলেছে, ভারত সন্ত্রাসবাদ থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইছে, সেটি তারা বুঝতে পারে। কিন্তু সেই আত্মরক্ষার নামে যেন এমন পদক্ষেপ না হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো বলেন, ‘আমি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব। আমি বিশ্বাস করি, কেউই দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে যেতে চায় না।’
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
নিজস্ব অবস্থান থেকে সরাসরি কোনো পক্ষ না নিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সরকার। আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে দুই দেশের উচিত কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে দুই দেশকেই সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ফের ২০১৯-এর ছায়া?
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই ২০১৯ সালের বালাকোট হামলা ও পাল্টা জবাবের সময়কার উত্তেজনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তখনও পুলওয়ামা হামলার জেরে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল এবং পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দিয়েছিল।
তবে এবারের বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক কারণ উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর এবং উভয়ের রাজনৈতিক আবহ এখন আরও জটিল। পরমাণু অস্ত্রধারী দুই দেশ যদি সংঘাতের পথে এগোয়, এর প্রভাব শুধু সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—তা ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বে। কূটনৈতিকভাবে এই সংকট নিরসনে বিশ্বের চাপ যত বাড়ছে, ময়দানে তার প্রতিফলন কতটা দেখা যাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এমন উত্তেজনা কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু প্রত্যেকবার এই ধরনের ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ সমাধানই হতে পারে দুই দেশের ভবিষ্যতের একমাত্র ইতিবাচক দিক। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—দিল্লি ও ইসলামাবাদ কী সিদ্ধান্ত নেয়।
উপমহাদেশ ডেস্ক
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link