নিউজনেস্ট

আরাকানের জন্য মানবিক করিডোর: বাংলাদেশ কি প্রস্তুত নতুন এক চ্যালেঞ্জের জন্য?

আরাকানের জন্য মানবিক করিডোর: বাংলাদেশ কি প্রস্তুত নতুন এক চ্যালেঞ্জের জন্য?
আরাকানের জন্য মানবিক করিডোর: বাংলাদেশ কি প্রস্তুত নতুন এক চ্যালেঞ্জের জন্য? ছবি : সংগৃহীত

আরাকান রাজ্যে চলমান সংঘাত, দুর্ভিক্ষ আর মানবিক বিপর্যয়ের মুখে আবারও আলোচনায় এসেছে ‘মানবিক করিডোর’ প্রসঙ্গ। জাতিসংঘ সম্প্রতি আরাকানে জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিতে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের ভূমিকাই হতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে দেশে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। জনমত, জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক ভারসাম্য ও মানবিক মূল্যবোধের এক জটিল সমীকরণে জড়িয়েছে পুরো বিষয়টি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে সম্মতি জানালেও বিষয়টি ঘিরে রাজনৈতিক ও জনসাধারণের পর্যায়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত দেশে নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকি, চরমপন্থার হুমকি এবং রোহিঙ্গাদের নতুন করে আগমনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। আবার অন্য একাংশ মনে করছেন—মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে এক ইতিবাচক ও সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটে তার আগের সহানুভূতিশীল অবস্থানের ধারাবাহিকতায়।

২০১৭ সালে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল বাংলাদেশ। মানবিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো সে সময়ের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল। এখন রাখাইন রাজ্যের ক্ষুধার্ত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ আরেকবার এসেছে।

মানবিক করিডোরের মাধ্যমে শুধুমাত্র সাহায্য নয়, সম্ভাব্যভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথও মসৃণ হতে পারে। তবে শর্ত হলো, যদি ভবিষ্যতে মিয়ানমারে আরাকানভিত্তিক কোনো গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আসে।বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি মানবিক করিডোর বাস্তবায়িত হলে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকা আরও জোরদার হবে। ফলে জাতিসংঘে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়তে পারে।

তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। প্রথমত, মিয়ানমারের সম্মতি ছাড়া করিডোর বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব, যা কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত, সীমান্তে করিডোর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলতে পারে। তৃতীয়ত, এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক হিসাব নিকাশে বাংলাদেশ পড়ে যেতে পারে এক অস্বস্তিকর টানাপোড়েনে।

তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে প্রশ্নটি থেকে যায় তা হলো—এই করিডোর কি সত্যিই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক হতে পারে? বিশ্লেষকদের মতে, রাখাইনে সাহায্য পৌঁছানো এবং সেখানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবিক করিডোর চালু হলে, সেটি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গঠনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারে। এটি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এমন এক সময়ে যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ রোহিঙ্গা সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশের নেতৃত্বে এই করিডোর উদ্যোগ মানবতার পক্ষে এক শক্তিশালী বার্তা দিতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জাতীয় স্বার্থ, কূটনৈতিক ভারসাম্য ও জনমতকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পরিশেষে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের যে নৈতিক অবস্থান ছিল এবং এখনো রয়েছে, তা মানবিক করিডোরের মধ্য দিয়ে আরও সুদৃঢ় হতে পারে। রাষ্ট্র যদি জনগণের অনুভূতি, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এই উদ্যোগ শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, বিশ্বব্যাপী মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।

উপমহাদেশ ডেস্ক
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত