ভারতের উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে গরুর মাংস বহন করার অভিযোগে দিনের আলোয় চার নিরীহ মুসলিমকে ঘিরে ধরে নির্মমভাবে পেটালো গোরক্ষার নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদী একদল দুষ্কৃতকারী। অথচ পুলিশ জানিয়েছে, ওই মাংস ছিল মহিষের—যা ভারতে বৈধ। ঘটনাটি ইতোমধ্যে ভয়াবহ গণপিটুনির আরেকটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
আত্রাউলি থেকে আলিগড়ের একটি মান্ডিতে পণ্য নিয়ে যাচ্ছিলেন সেলিম খান ও তার ভাগ্নে আকিল ইব্রাহিম। সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন দিনমজুর। পণ্যবাহী কন্টেইনার ট্রাকে করে রওনা হয়েছিলেন তারা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই আলিগড়ের উপকণ্ঠে একদল উগ্র হিন্দুত্ববাদী ‘গোরক্ষক’ পথ আটকায় তাদের।
চোখের পলকে জমে ওঠে উত্তেজক ভিড়। ‘গরুর মাংস বহন করা হচ্ছে’—এই অভিযোগ তুলে দুষ্কৃতকারীরা গাড়ি ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তারা সেলিমদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় তারা হামলা চালায়।
হামলার নেতৃত্বে ছিলেন রামকুমার আর্য ও অর্জুন ওরফে ‘ভোলু’। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, তারা ও তাদের অনুসারীরা লোহার রড, লাঠি ও বাটন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে চারজনের ওপর। চলতে থাকে অকথ্য মারধর। রক্তাক্ত, অচেতন অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় আহতদের। অনেকে শুধু দাঁড়িয়ে দেখে, কেউ কেউ ভিডিও করে, কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।
এদিকে গণপিটুনির পর হামলাকারীরা তাদের মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। শেষে কন্টেইনার ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরো গাড়ি পুড়ে যায়। আশেপাশে পুলিশ থাকলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয় বলে জানা গেছে।
ঘটনার পর পুলিশ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে এফআইআর দায়ের করেছে। আরও ২০-২৫ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বেশিরভাগই আলিগড় জেলার হারদুয়াগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দা।
পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় ন্যায় সঞ্চিতা, ২০২৩ অনুযায়ী মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে ধারা ১৯১(২), ১৯১(৩), ১৯০, ১০৯, ৩০৮(৫), ৩১০(২) ও ৩(৫)-এর অধীনে। আলিগড় জেলার গ্রামীণ পুলিশ সুপার অমৃত জৈন এক ভিডিও বিবৃতিতে জানান, পুলিশ দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। জব্দ করা মাংস ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তদন্ত চলছে।
তিনি আরও জানান, পণ্য পরিবহনের কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ট্রান্সপোর্টারের সব লাইসেন্স বৈধ ছিল।
স্থানীয় এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, ‘মামলা হয়, মাঝে মাঝে গ্রেফতারও হয়—কিন্তু বিচার? বিচার কখনও হয় না।’ তিনি বলেন, ‘একটা চেনা প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে— গরুর মাংসের অভিযোগ তুলে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।‘
এই ভয়াবহ ঘটনার পরও বড় রাজনৈতিক দলগুলো বা প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে কোনও বিবৃতি আসেনি। জাতীয় মিডিয়াও ঘটনাটি নিয়ে চুপচাপ। স্থানীয়ভাবে কিছু প্রতিবাদ ও স্বাধীন মিডিয়ার প্রতিবেদন ছাড়া প্রায় কেউই মুখ খোলেনি।
আলিগড়ের এক অধ্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গঙ্গা-যমুনার ঐতিহ্য বলে যে কথা বলি, তা আজ কোথায়? যদি ভিত্তিহীন সন্দেহে মুসলমানদের পিটিয়ে শহিদুল পপউ৪দ6 হয়, আর আমাদের সাংস্কৃতিক নেতারা চুপ থাকেন, তাহলে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি?’
বজরং দলের নেতারা দাবি করেছে, ওই গাড়িটি আগেও ‘অবৈধ মাংস’ বহন করেছিল। তবে পুলিশ জানায়, এবার যে মাংস পাওয়া গেছে তা মহিষের—যা ভারতে বৈধ।
এটি একক ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গো-রক্ষার নামে বহু মুসলিম পুরুষকে পিটিয়ে শহিদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে একটি ভয়ংকর চক্র—গুজব, অভিযোগ, গণপিটুনি এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক ধরনের নীরবতা।
সূত্র এমএম