একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার প্রেক্ষিতে বিশ্ব এখন হামাস ও দখলদার ইসরায়েলের মধ্যে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তির দিকে তাকিয়ে আছে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, এই চুক্তির সম্ভাব্য ধাপ ও শর্তাবলী। এতে গাজা পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
নিচে চুক্তির মূল পয়েন্ট এবং বাস্তবায়নের আগে প্রক্রিয়ার বিবরণ দেওয়া হলো:
চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্ব প্রস্তুতি
১. চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হওয়ার পর তা ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার (ক্যাবিনেট) এবং সম্প্রসারিত সরকারের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রয়োজনে এটি পার্লামেন্টেও (কনেসেট) উপস্থাপন করা হতে পারে।
২. অনুমোদনের পর ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষ সেসব বন্দির তালিকা প্রকাশ করবে, যাদের মুক্তি দেওয়া হবে। এ তালিকার ওপর আপত্তি জানানোর সুযোগ দেওয়া হবে। তবে অতীতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট সাধারণত এসব আপত্তি নাকচ করে দেয়।
৩. তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর, দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিতে প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ ক্ষমা প্রদান করবেন। তবে চুক্তি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে, তাই সব বন্দির মুক্তি একসাথে হবে না।
চুক্তির ধাপসমূহ
চুক্তি তিনটি ধাপে ৪২ দিন ধরে বাস্তবায়িত হবে। তবে ইসরায়েল চাইছে এটি দুই ধাপে সীমিত করতে।
প্রথম ধাপ
- প্রথম ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দি মুক্তি পাবে। এর মধ্যে জীবিত, মৃত, নারী, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত।
- ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার অধিকাংশ এলাকা থেকে প্রত্যাহার করবে।
- যুদ্ধবিরতির সাত দিনের মাথায় প্রথম দফার মুক্তি কার্যকর হবে।
- প্রতিটি নারী বন্দি বা বয়স্ক ইসরায়েলির বিনিময়ে ৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে। এর মধ্যে ৩০ জন আজীবন কারাদণ্ড পাওয়া এবং ২০ জন দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত।
দ্বিতীয় ধাপ
চুক্তির ১৬শ দিনে দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে। এতে গাজায় বাকি যুবক ও সেনাদের মুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে। আর প্রথম ধাপের পঞ্চম সপ্তাহের মধ্যে এই ধাপের চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
তৃতীয় ধাপ
শেষ ধাপে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা ও গাজার পুনর্গঠনের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর
চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম দিন থেকেই গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি আবাসিক এলাকার সীমান্ত এলাকা থেকে সরে যাবে। ড্রোন কার্যক্রম প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে, আর বন্দি বিনিময়ের দিনগুলোতে এটি ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে।
ইসরায়েলি সেনারা ধীরে ধীরে গাজা থেকে প্রত্যাহার করবে। এর মধ্যে নেটজারিম করিডোর থেকে সরে যাওয়াও অন্তর্ভুক্ত, যা গাজার উত্তরাংশকে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। একই সাথে তারা গাজা-মিসর সীমান্তের ফিলাডেলফিয়া করিডোর থেকেও সরে যাবে।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে, শান্তি স্থায়ীত্ব লাভ করবে। এতে সামরিক অভিযান স্থায়ীভাবে বন্ধ এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে, যাতে পণ্য ও মানুষের চলাচল সহজ হয়।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি
প্রথম ধাপ
- প্রতিটি ইসরায়েলি বেসামরিক বন্দির বিনিময়ে ৩০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে।
- প্রতিটি ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে ৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে। এর মধ্যে ৩০ জন আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং ২০ জন দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত।
- ২০১১ সালের বন্দি বিনিময় চুক্তিতে মুক্তি পাওয়া এবং পরবর্তীতে পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়া ৪৭ ফিলিস্তিনি বন্দি প্রথম ধাপে মুক্তি পাবেন।
পরবর্তী ধাপ
দ্বিতীয় ধাপে আরও সেনাদের বিনিময়ে বন্দি মুক্তির আলোচনা হবে। পাশাপাশি বন্দি বিনিময়ের সময় ফিলিস্তিনি বন্দিদের পুরোনো অভিযোগে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হবে না।
মানবিক সহায়তা প্রবেশ
চুক্তি কার্যকরের প্রথম দিন থেকেই গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ শুরু হবে। প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক, যার মধ্যে ৫০টি জ্বালানি বহনকারী ট্রাক থাকবে। এর মধ্যে ৩০০ ট্রাককে গাজার উত্তর অংশে সরবরাহ করা হবে।
এই সহায়তা তিনটি ধাপেই চলমান থাকবে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা পুরো গাজা জুড়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
পরিসংখ্যানের দিক
ইসরায়েলি কারাগারে ১০,৩০০ ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছে। অন্যদিকে গাজায় ৯৮ জন ইসরায়েলি বন্দি রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় বেশ কয়েকজন বন্দি নিহত হয়েছেন।
উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন
চুক্তি কার্যকরের প্রথম দিন থেকেই গাজার দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজার নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গাজার সকল এলাকায় বাসিন্দাদের অবাধ চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।
পুনর্গঠন কার্যক্রম
চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠন শুরু হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে—
- বিদ্যুৎ, পানি, পয়নিষ্কাশন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক পুনর্নির্মাণ।
- ধ্বংসস্তুপ ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ।
- গৃহহীন উদ্বাস্তুদের জন্য অন্তত ৬০ হাজার অস্থায়ী ঘর (ক্যারাভান) এবং ২ লাখ তাঁবু সরবরাহ।
- যুদ্ধের ফলে ধ্বংস হওয়া বাড়ি, বেসামরিক স্থাপনা এবং নাগরিক অবকাঠামো পুনর্গঠন।
গাজার শাসন ব্যবস্থা
চুক্তির পর গাজা শাসনের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে, এটি এখনো অমীমাংসিত। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হওয়ায় বর্তমান আলোচনা পর্বে এটি উপেক্ষা করা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি চুক্তির ক্ষেত্রে এটি একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
চুক্তির গ্যারান্টি প্রদানকারী দেশগুলো
এই চুক্তি বাস্তবায়নে গ্যারান্টি দিবে কাতার, মিসর এবং যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া তৈরিতে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে।
এই পদক্ষেপগুলো গাজার স্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সূত্র: আল জাজিরা