২০২৪ সালের ইসরায়েল-লেবানন সংঘাত: আধুনিক যুদ্ধনীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব

২০২৪ সালের ইসরায়েল-লেবানন সংঘাত: আধুনিক যুদ্ধনীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব
২০২৪ সালের ইসরায়েল-লেবানন সংঘাত: আধুনিক যুদ্ধনীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব। ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সংঘাত নতুন মাত্রা পায়। এই সংঘর্ষ শুধু ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে গোটা পশ্চিম এশিয়ায়। ইসরায়েল তাদের দাবি অনুযায়ী হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও, এই যুদ্ধে তারা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে লেবাননের নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ও দুর্ভোগ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।

ইসরায়েল-লেবানন বিরোধের শিকড় মূলত ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। হিজবুল্লাহ ১৯৮০-এর দশকে গঠিত একটি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী। লেবাননে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধের মুখ্য শক্তি। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরে গাজায় সহিংসতা নতুন করে শুরু হলে, লেবানন ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরব হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

সেপ্টেম্বর, ২০২৪-এর হামলা

১২ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসরায়েল লেবাননে ব্যাপক হামলা চালায়। ড্রোন, নির্ভুল নির্দেশিত বোমা, সাইবার যুদ্ধের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর অবকাঠামো। তবে বাস্তবে এসব হামলায় বহু নাগরিক স্থাপনাও ধ্বংস হয়।

নাগরিক ব্যবস্থাপনায় আঘাত

যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেলিভিশন চ্যানেল, হাসপাতাল, স্কুল—সবই ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এতে হিজবুল্লাহর যোগাযোগ দুর্বল করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হামলার নিন্দা জানালেও ইসরায়েল তাদের কৌশলগত প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায়। এই নির্মম সহিংসতায় বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারান। যার ফলে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

ইসরায়েল তাদের অভিযানের পক্ষে দাবি করে, হিজবুল্লাহর হুমকি মোকাবেলায় এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। তারা ‘আধুনিক যুদ্ধের নীতি’ অনুসরণ করছে বলে উল্লেখ করলেও প্রশ্ন উঠেছে এই নীতির নৈতিকতা ও আইনি বৈধতা নিয়ে।

বৈশ্বিক প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ

এই সংঘর্ষ গোটা অঞ্চলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ইরান ও সিরিয়া, যারা লেবাননের মিত্র, তারা উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য ইসরায়েলের নীতিকে দায়ী করে। সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বাধার সম্মুখীন হয়। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামো পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জও সামনে আসে।

আরব বিশ্বের নীরবতা

আরব বিশ্বের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব। যদিও অনেক দেশ ফিলিস্তিনের প্রতি মৌখিক সমর্থন জানিয়েছে। তবে বাস্তব কোন পদক্ষেপ ছিল না বললেই চলে। বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক স্বার্থ ও পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ থেকে বিরত থেকেছে। এই অবস্থান লেবাননকে আরও বেশি করে অনিরাপদ করে তুলে।

ভারতের অবস্থান: প্রকৃত চিত্র

ভারতের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। শুরু থেকেই ভারত ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। গাজা ও লেবাননের পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতার পরও ভারত ইসরায়েলের সমর্থনে সরব থেকেছে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ভারত অতীতে যে ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলত, এই সংঘাতে এসে তা কার্যত ভুলে গেছে।

ভারত শুধু কূটনৈতিক নয়, নানা পর্যায়ে ইসরায়েলের সমর্থনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অস্ত্র চুক্তি, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের অবস্থানকে জোরালোভাবে সমর্থন করার বিষয়টি স্পষ্ট। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ভারতের ইন্দো-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডর (IMEC) প্রকল্প, যা গাজা যুদ্ধের কারণে স্থগিত হয়েছে। তবুও ভারত ইসরায়েলের প্রতি আনুগত্যে কোন ঘাটতি রাখেনি।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষ স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে, এই অঞ্চল কতটা জটিল ও বিপজ্জনক। ইসরায়েলের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হামলা এবং এই হামলাকে ‘আধুনিক যুদ্ধনীতি’ বলে সমর্থন দেওয়া নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

লেবাননের পাল্টা প্রতিরোধ, ইরান-সিরিয়ার সমর্থন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট সমর্থন এবং জাতিসংঘের ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে এই সংঘাত আরও ঘনীভূত হয়েছে। ভারতের মতো দেশগুলোর পক্ষপাতমূলক অবস্থান এবং আরব বিশ্বের নীরবতা এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।

ভবিষ্যতে এই সংঘাতের সমাধান করতে হলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার হবে। না হলে, এই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

আমাদের ফলো করুন