কাশ্মির। যার সবুজ উপত্যকা আর বরফে ঢাকা পাহাড় বহু কবির কল্পনায় উঠে এসেছে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যরূপে। সেই ভূস্বর্গের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে এক মরণঘাতী বিপদ। দশকব্যাপী সংঘাতের ভয়াবহ স্মৃতি হিসেবে কাশ্মিরের জমিনে রয়ে গেছে বিপুলসংখ্যক ল্যান্ডমাইন ও অবিস্ফোরিত বোমা (UXO)। যুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া এই ভয়াবহ ল্যান্ডমাইনগুলো এখন পর্যন্ত মানুষের জীবন ও কাশ্মীরের প্রকৃতির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে রয়ে গেছে।
কাশ্মিরের অত্যন্ত সেনাসমৃদ্ধ সীমান্ত এলাকা—লাইন অব কন্ট্রোল (LoC)—জুড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অসংখ্য মাইন পেতে রেখেছে। কথিত ‘অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতে ও সামরিক ঘাঁটি রক্ষা করতে তারা এমনটা করেছ। কিন্তু এই মাইনগুলো শুধু শত্রুদের জন্যই নয়; বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরীহ গ্রামবাসী, পশু এবং পরিবেশের জন্যও। আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেগুলোর সঠিক মানচিত্র বা চিহ্ন না থাকা। ফলে চারণভূমি, কৃষিজমি এমনকি আবাসিক এলাকাও পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।
মানবিক বিপর্যয়: পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা
এখন পর্যন্ত এই নীরব ঘাতকের শিকার হয়েছে কত মানুষ—তার পূর্ণাঙ্গ সরকারি পরিসংখ্যান আজও মেলেনি। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং বেঁচে ফেরা মানুষের হৃদয়বিদারক বর্ণনায় কিছু চিত্র স্পষ্ট হয়।
‘ল্যান্ডমাইন অ্যান্ড ক্লাস্টার মিউনিশন মনিটর’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মাইন, আইইডি ও অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩,১৯১ জন। এর মধ্যে ১,০৮৩ জন নিহত এবং ২,১০৭ জন আহত হন। এই বিপুল সংখ্যক হতাহতের বড় অংশই ঘটেছে কাশ্মির অঞ্চলে।
শুধু মানুষ নয়, ছাড় নেই প্রকৃতিরও
এই বিধ্বংসী বোমার কারণে শুধু মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাশ্মিরের বাস্তুতন্ত্রও। হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী এবং প্রাকৃতিক বাসস্থানও মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হচ্ছে। নিরীহ পশুপাখি, পাহাড়ি বন্যপ্রাণী, এমনকি বিপন্ন প্রজাতিও এই বিস্ফোরণে প্রাণ হারাচ্ছে নিয়মিত।
অনেক গ্রামেই এখনও কাশ্মিরিরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটান। চারণভূমিতে গরু ছাড়তে ভয়। মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখা মৃত্যুর ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন শিশু, বৃদ্ধ, গরু, মেষ এমনকি সেনারাও।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই বলছেন, যুদ্ধের শেষ নেই—কিন্তু যেন অন্তত যুদ্ধের রেখে যাওয়া মৃত্যুকূপগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ, এই মাইনগুলো শান্তির সময়েও নীরব হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
কাশ্মিরের কুপওয়াড়া, পুঞ্চ এবং বারামুল্লার মতো সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে জাগে এক অদৃশ্য আতঙ্কে। লাইন অব কন্ট্রোল (LoC) সংলগ্ন গ্রামগুলোতে মাঠে কাজ করতে নামা কৃষক, পশুচারণে যাওয়া রাখাল কিংবা খেলতে বের হওয়া শিশু—কারও জন্যই নিরাপদ নয় এই ভূমি। এখানে পা রাখার মানেই হতে পারে পায়ের নিচে বিস্ফোরণ, জীবনভর পঙ্গুত্ব কিংবা তাৎক্ষণিক মৃত্যু।
মানবিক কিছু বেদনার গল্প:
এই অঞ্চলের মানুষের জীবন কেমন অসহায়—তা বোঝা যায় নিচের কিছু করুণ কাহিনিতে:
১. মোহাম্মদ ইয়াকুব, কুপওয়ারার এক শ্রমিক। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে সেনা টহল শেষে বাড়ি ফেরার পথে মাইনে পা পড়ে একটি পা হারান। এরপর তার স্ত্রী তাকে তালাক দেন। তিনি এখন মাত্র ১,০০০ রুপি মাসিক ভাতায় দুই মেয়েকে বড় করছেন।
২. হাকাম বেগম, ২১ বছর বয়সী একজন নারী। ২০১৭ সালের আগস্টে উরি-তে ঘাস কাটতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে ডান পা হারান। চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তার স্বামী এখন প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনার পোর্টার হিসেবে কাজ করেন।
৩. হায়দার মুগল, কুপওয়ারার কৃষক। ১৯৯৭ সালে নিজের জমিতে গবাদিপশু চরাতে গিয়ে একটি পা হারান। চিকিৎসার খরচ চালাতে নিজের পশু বিক্রি করতে হয়। এখন তিনি একটি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন, যার বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তার পক্ষে ভারী বোঝা।
৪. গুলাব জান। ১৯৯৫ সালে মাঠে কাজ করার সময় ডান পা হারান। কোনও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে আজও দিন কাটাচ্ছেন সামান্য ভাতায়।
৫. সোনি বেগম। ১৯৯৮ সালে উরিতে গবাদিপশু চরাতে গিয়ে পা হারান। তিন বছর পর তার স্বামী, যিনি সেনার পোর্টার হিসেবে কাজ করতেন, একইভাবে পা হারান। তাদের জমিও আজ ব্যবহারের অযোগ্য। কোনও ক্ষতিপূরণও মেলেনি।
এসব গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরে এক গভীর ব্যর্থতা—যেখানে ক্ষতিগ্রস্তরা পায় না পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ। আবার ভাতা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আর পুনর্বাসনের তো কোন কার্যকরী নীতিই নেই।
এদিকে বৃষ্টিপাত বা তুষারপাতের ফলে মাইনগুলোর স্থানচ্যুতি ঘটে। ফলে পুরনো সতর্কবার্তাও হয়ে পড়ে অকার্যকর। অনেক সময় মাঠ ঘেঁষে দেওয়া হয় না কোনও সাইনবোর্ড বা ঘেরাও—ফলে যে কেউ হঠাৎ পড়তে পারেন মরণফাঁদে।
এই শারীরিক ক্ষত ছাড়াও রয়েছে গভীর মানসিক যন্ত্রণা। প্রতিটি দিন শুরু হয় একটা অজানা ভয় নিয়ে—যদি হঠাৎ কিছু ঘটে যায়! ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হচ্ছে, শিশুরা খেলতেও ভয় পায়। দারিদ্র্য বাড়ছে, পরিবারগুলো ভেঙে পড়ছে, আর এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন থমকে গেছে।
প্রকৃতির ওপর মাইনের কালো ছায়া
কাশ্মিরের অনন্য প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যও রেহাই পাচ্ছে না এই মরণফাঁদ থেকে। বিস্ফোরক পদার্থে দূষিত হচ্ছে জমি। গাছপালার বৃদ্ধিতে ব্যাহত হচ্ছে। আর সরাসরি বিস্ফোরণে মরছে বহু বন্যপ্রাণী।
সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে হাংগুল হরিণ। কাশ্মিরের প্রতীকপ্রায় এই প্রাণীটি সাধারণত লাইন অব কন্ট্রোলের আশপাশে ঘোরাফেরা করে, যেসব এলাকায় মাইন পুঁতে রাখা হয়। এছাড়া হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার, স্নো লেপার্ড এবং বহু পাখি প্রজাতিও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে। মাইনের ভয়েই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অভয়ারণ্যে প্রবেশ, যা পশুদের বাসস্থান, প্রজনন ও চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সমাধানের পথে যে পাঁচটি করণীয় জরুরি
১. মাইন পরিষ্কারে জোর দেওয়া: আরও অর্থায়ন, দক্ষ জনবল, উন্নত প্রযুক্তি ও সুনির্দিষ্ট মানচিত্র ব্যবহার করে দ্রুত ডিমাইনিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
২. সচেতনতা কার্যক্রম: শিশু ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে মাইন চিনে নেওয়া, রিপোর্ট করা ও সতর্কতা মেনে চলা শেখাতে হবে। স্কুলপাঠ্যক্রমেও এটি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
৩. ভুক্তভোগী সহায়তা: পর্যাপ্ত চিকিৎসা, পুনর্বাসন, মানসিক চিকিৎসা এবং বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম অঙ্গ সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণেও সহায়তা দিতে হবে।
৪. নীতিগত স্বচ্ছতা: ভারত সরকারকে হতাহতের সঠিক রেকর্ড রাখতে হবে। যদিও দেশটি এখনও ১৯৯৭ সালের মাইন নিষেধ চুক্তিতে সই করেনি, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে অংশগ্রহণে আরও স্বচ্ছতা দেখানো উচিত।
৫. রাজনৈতিক সমাধান: স্থায়ী শান্তির পথে না হাঁটলে নতুন মাইন বসানো বন্ধ হবে না। যুদ্ধ থামানোই হবে সবচেয়ে বড় সমাধান।
কাশ্মিরের মাটি যতই রূপকথার সৌন্দর্যে ভরপুর হোক না কেন, সেই মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা মরণফাঁদগুলো এক নির্মম বাস্তবতা। যতদিন না তা সরানো হয়, ততদিন কাশ্মীর শুধু রূপকথার ভূমি নয়—তা হয়ে থাকবে এক নীরব মৃত্যুর উপত্যকা।
সূত্র: এএনএ
উপমহাদেশ ডেস্ক
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link