বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। তবে এই ঘোষণা হঠাৎ আসেনি—এর পেছনে রয়েছে রাজপথের চাপ, দীর্ঘ গোপন প্রস্তুতি এবং তীব্র জনমত।
গতকাল শনিবার ১০ই মে রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে, যাতে কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
সেইসঙ্গে বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম, এমনকি সাইবার স্পেসেও, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টার ভাষায়, ‘দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং ট্রাইব্যুনালের বাদী-সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল।’
এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্তও রাজপথে উত্তেজনা ছিল চরমে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতৃত্বাধীন তিন দফা দাবির আন্দোলন প্রতিদিনই তীব্রতর হচ্ছিল। আন্দোলনকারীরা ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচির ঘোষণা দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দেয়, আর সেই সময়েই চলছিল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক।
অবশেষে রাত ১১টায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হলে আন্দোলনকারীরা রাজপথে উল্লাস প্রকাশ করেন। বিভিন্ন এলাকায় আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণসহ উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ আসেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই নেওয়া হচ্ছিল। সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন—উভয়ের ধারাকে সামনে রেখেই পরিকল্পনা গুছিয়ে রাখে মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার পরই দ্রুত আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন—উভয়ের অপশনেই আলোচনা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জামায়াতকে যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও একই আইনি কাঠামো ব্যবহারের প্রস্তুতি ছিল।’
২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। পরে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করে। এবার সেই একই ধারার ছায়া এসে পড়ল আওয়ামী লীগের ওপর। এমনকি ছাত্রলীগকেও গত বছরই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
আগামী কর্মদিবসে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। একইসঙ্গে, উপদেষ্টা পরিষদ আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
তবে এনসিপি নেতারা আন্দোলন থামানোর কোনো ঘোষণা দেননি। বরং দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—তিন দফা দাবি পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া তারা রাজপথ ছাড়বেন না।
গতকাল শনিবার রাত থেকেই রাজধানীর যমুনা ভবন এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের সমন্বয়ে মাল্টি-লেয়ার সিকিউরিটি গড়ে তোলা হয়। সচিবালয় এলাকাও ছিল নজরদারিতে।
এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। সামনে কী হয়, তা নির্ভর করছে বিচার প্রক্রিয়া, জনমত এবং আন্দোলনের গতিপথের ওপর। তবে আপাতত ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায় রচিত হলো—জনগণের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা পুরনার্থে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল, যুদ্ধাপরাধ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ হলো।