ইসলাম পৃথিবীতে নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও—যে যুগে নারীদের ওপর চরম অবিচার করা হতো— ইসলামের উদার শিক্ষা নারীকে দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের প্রতি মর্যাদাবোধ, স্নেহ এবং সমান অধিকারের অসংখ্য উদাহরণ রেখে গেছেন, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চলুন, আমরা কিছু স্মরণীয় ঘটনার মাধ্যমে নারীদের সম্পর্কে নবিজীর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনাগুলো পর্যালোচনা করি।
স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণের নিদর্শন
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের প্রতি ছিলেন সর্বদা স্নেহপরায়ণ ও সহানুভূতিশীল। একবার হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা -এর সাথে তিনি একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রথম দৌড়ে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা জয়লাভ করেন। কিছুদিন পর তারা আবার দৌড় প্রতিযোগিতা করেন, এবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিতে যান। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এইবার আমি জিতেছি’— একটি ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রসবোধ এবং স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্পষ্ট হয়। (সিরাত ইবনে হিশাম)
কন্যা সন্তানের লালনে মহানবীর ভালোবাসা
মেয়ে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর জন্মে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঅত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। সেই অন্ধকার সময়েও—যখন কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো—মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কন্যাকে বিশেষ স্নেহে লালন-পালন করেন। তিনি যখন ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু এর ঘরে প্রবেশ করতেন, দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানাতেন, তার হাত ধরে চুমু দিতেন এবং নিজের বসার জায়গায় বসাতেন। এটা শুধু তার ব্যক্তিগত ভালোবাসার নিদর্শন নয়, বরং সকল পিতার জন্য কন্যাদের প্রতি কীভাবে ভালোবাসা প্রদর্শন করা উচিত তার শিক্ষা। (আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ইবনে সাদ)
ইসলামে নারীশিক্ষা
ইসলাম নারীদের শিক্ষা গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করেছে। একদিন, কিছু নারী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে অনুরোধ করেন যে, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন রাখা হোক, যাতে তারা ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের অনুরোধ মেনে নেন এবং তাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করেন। সেই দিনে তিনি তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করতেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, ইসলামে নারীশিক্ষার গুরুত্ব কতখানি ছিল। (আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ইবনে সা’দ)
নারীদের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দয়ার্দ্র চরিত্রের একটি সুন্দর উদাহরণ দেখা যায় আম্মাজান হযরত সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু-এর সাথে এক সফরে। । সফরে সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু এর উট ধীরে চলছিল, যার কারণে তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে চোখের পানি মুছে দেন এবং তাকে সান্ত্বনা দেন। এ ঘটনাটি থেকে বোঝা যায়, নারীদের প্রতি তার সহানুভূতি ও যত্ন কতটা গভীর ছিল। (সিরাত ইবনে হিশাম)
বিদায় হজে নারীদের জন্য বিশেষ উপদেশ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজে উম্মতের উদ্দেশ্যে যে মহামূল্যবান উপদেশগুলো প্রদান করেন, তার মধ্যে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করো।’ এমনকি যখন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু মুসলিম নারীদের অতিরিক্ত চাহিদার কথা বলে অভিযোগ করেন, তখনও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের অধিকারের ব্যাপারে সদয় হতে পরামর্শ দেন। (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, আল-তাবারি)
ইসলাম নারীকে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই নারীদের প্রতি তার আচরণ এবং উদারতার মাধ্যমে বারবার তা প্রমাণ করেছেন। তার শিক্ষা ও দৃষ্টান্ত থেকে আমরা শিখতে পারি—নারীকে স্নেহ, সম্মান এবং সমান অধিকার দেওয়াই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।