নিউজনেস্ট

চাবাহার বন্দর: আঞ্চলিক পরাশক্তি হতে ভারতের অন্যতম হাতিয়ার

চাবাহার বন্দর: আঞ্চলিক পরাশক্তি হতে ভারতের অন্যতম হাতিয়ার
চাবাহার বন্দর: আঞ্চলিক পরাশক্তি হতে ভারতের অন্যতম হাতিয়ার। ছবি: আল জাজিরা

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজেদের  শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে এবং আঞ্চলিক প্রভাবশালী হওয়ার কৌশল হাতে নেয় ভারত। এই কৌশল ভারতের জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টাই নয়; বরং চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও বটে। এই পদক্ষেপে ভারতের আরেকটি লক্ষ্য ছিল; যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন অর্জন এবং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।

চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তি

ব্রিটিশ উপমহাদেশ ছাড়ার পর থেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত এবং চীন। এশিয়ার এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগতভাবেও বিস্তৃত। এদিকে ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান চীনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হওয়ায়, ভৌগলিকভাবে ভারত এক প্রকার সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতকে যা উদ্বিগ্ন করায় ভারতও কৌশলগত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় নেওয়া শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

ভারতের ডায়মন্ড নেকলেসকৌশল

সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ‘মুক্তোর মালা’ নামে এক দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গ্রহণ করেছে চীন। ইতিমধ্যে যেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন দেশে সামরিক স্থাপনা ও বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণ করছে চীন। যেসব বন্দরের মাধ্যমে সমুদ্রে একটি কৌশলগত বেষ্টনী তৈরি করে চীন সামুদ্রিক প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি নিজেদের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। অপরদিকে চীনের এই কৌশলের জবাবে ভারত নিজস্ব ‘ডায়মন্ড নেকলেস’ কৌশল গ্রহণ করে। যেই কৌশলের আওতায় ভারত চীনের চারপাশে সামরিক ঘাঁটি এবং মিত্রদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে, যা দেশটিকে ভারত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে তার উপস্থিতি শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।

উল্লেখ্য, ‘ডায়মন্ড নেকলেস’ কৌশল বাস্তবায়নে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে ইরানের চাবাহার বন্দর। কারণ, এই বন্দরই ভারতকে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি দিয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বাজারে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এই বন্দর দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এদিকে কোয়াড নিরাপত্তা সংলাপের ভারতের এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াসহ মিত্র দেশগুলোও সমর্থন করছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যা ভারতকে আরও শক্তিশালী করছে।

চাবাহার বন্দরের গুরুত্ব       

ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ইরানের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বাজারের প্রধান প্রবেশদ্বার। এদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানে ভারতের  অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। চাবাহার বন্দরের অবস্থান ভারতের জন্য ইরান থেকে তেল এবং গ্যাসের সরবরাহ সহজলভ্য করে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়িয়ে তুলবে।

ভারত চাবাহার বন্দরকে ২০০০ সালে ইরান রাশিয়ার সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে উন্নত সংযোগ ও বিকল্প বানিজ্য রুট হিসেবে বাস্তবায়নাধীন ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ করিডোর (INSTC) এর মূলকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কারণ, এর মধ্যমে ইরানের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারবে ভারত। যা ভারতকে হরমুজ প্রণালী ও সুয়েজ খালের মত ঐতিহাসিক বাণিজ্যরুটগুলোকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ার বাজারে দ্রুত প্রবেশের সুবিধা দেবে।

ভারতের চাবাহার বন্দরের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন উদ্যোগ

এতসব সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ১৯৯০ এর দশকে ভারত চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় এবং ২০০৩ সালে ভারত-ইরানের মাঝে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এরপর ২০১৬ সালে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত ইরানের সঙ্গে যুক্ত হয় আফগানিস্তান। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারত চাবাহার বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে ৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করে এবং আফগানিস্তানের সাথে যোগাযোগের জন্য একটি পরিবহন করিডোর স্থাপন করে। যে করিডোর পাকিস্তানকে বাইপাস করে ভারতকে সরাসরি আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ দেবে।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে ভারত এবং ইরান চাবাহারে বন্দরের ‘শহিদ বেহেশতি’ টার্মিনালের উন্নয়নের জন্য একটি ১০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার অধীনে ভারত ১২ কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং ২৫ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। যার মাধ্যমে বন্দরটির অবকাঠামো উন্নয়ন আরও জোরদার হবে এবং ভারতের জ্বালানি ও বাণিজ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।

চাবাহার বন্দর ও ইরানের ভূরাজনৈতিক কৌশল

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য নিষেধাজ্ঞার চাপ থেকে মুক্তি পেতে ইরান চাবাহার বন্দরকে একটি সমাধান হিসেবে মনে করে। তেহরান বিশ্বাস করে এই বন্দরটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইরানের অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইরানের বৃহত্তর কৌশলের এই অংশ চাবাহার বন্দর আন্তর্জাতিক বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। ইরানের পরিবহন ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী মেহেরদাদ বাজারবাস বলেন, চাবাহার বন্দর আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে পারে এবং তা ইরানের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চ্যালেঞ্জ ও ভারতের করণীয়       

তবে ভারতের চাবাহার বন্দর উন্নয়নে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো বড় বাধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেন, চাবাহার বন্দরটি শুধুমাত্র ভারত এবং ইরানের কৌশলগত স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক কৌশলে চাবাহারের ভূমিকা

অন্যদিকে আফগানিস্তানও চাবাহার বন্দরকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কারণ, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে এবং দেশটির জন্য একটি প্রধান বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার হিসেবে চাবাহার বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার পাকিস্তানি বন্দরের বিকল্প হিসেবেও আফগানিস্তানের জন্য চাবাহার বন্দরের গুরুত্ব বেশ। একই সাথে এই বন্দর ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যগুলোকে দ্রুত আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে পারবে আফগানিস্তান। এসব গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই ভারতের সহায়তায় চাবাহার থেকে আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছাকাছি ইরানি শহর জাহেদান পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মিত হচ্ছে, যা বাণিজ্য সংযোগকে আরও সুসংহত করবে।

চাবাহার বন্দরের চ্যালেঞ্জ

চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এ নিষেধাজ্ঞাগুলি অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা তৈরি করছে। অন্যদিকে, চীন পাকিস্তানের গদর বন্দর উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যা চীনের বাণিজ্যিক রুটে সরাসরি সংযুক্ত এবং এটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত। এছাড়া ইরানের অভ্যন্তরীণ রেলপথের উন্নয়নও ধীরগতিতে চলছে, যা চাবাহারের কার্যকারিতাকে সীমিত করে রাখছে।

মোটকথা চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য কেবল একটি বাণিজ্য পথ নয়, বরং চীনের প্রভাবের বিপরীতে দাঁড়ানোর একটি কৌশলগত অস্ত্র। ভারতের  ‘ডায়মন্ড নেকলেস’নামক সমুদ্র কৌশলের অংশ হিসেবে চাবাহার বন্দর চীনের ‘মুক্তোর মালা’সমুদ্র কৌশলের মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হতে পারে। তবে বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাই  চাবাহারের উন্নয়নের মূল বাঁধা।

সুহাইল শামীম
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত