তিন বছর হতে চলল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বয়স। দীর্ঘ এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের অবস্থান দিচ্ছে না কোন শান্তির আভাস। গতকাল ছিল এই যুদ্ধের ৯৪৫তম দিন। এই দিনে যুদ্ধের ময়দানে এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে ঘটেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সংঘাত পরিস্থিতি
গতকাল (২৫শে সেপ্টেম্বর) বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাশিয়া থেকে দফায় দফায় চালানো আক্রমণে ৭৮টি কামিকাজি ড্রোন এবং ৬টি ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত করেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এ খবর নিশ্চিত করেছে। তবে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী ৬৬টি ড্রোন এবং ৪টি ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে প্রতিরোধ করেছে বলে জানা গেছে।
এব্যাপারে ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শিহাল জানিয়েছেন, এই আক্রমণ মূলত ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে করা হয়েছে।
এদিকে ওডেসার কৃষ্ণ সাগর বন্দরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় একজন নারী নিহত হয়েছেন। অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জাপোরিঝিয়ায় পরিচালিত বোমা হামলায় আহত হয়েছেন আরও ১০ জন।
এছাড়া ইউক্রেনের খেরসনের পশ্চিমে একটি গ্রামে রুশ বাহিনীর লাগাতার মর্টার শেলিংয়ে অন্তত একজন নিহত এবং একজন আহত হয়েছেন বলে ইউক্রেনের আঞ্চলিক গভর্নর ভিয়াচেস্লাভ প্রোকুদিন জানিয়েছেন।
এদিকে খারকিভের স্লাতিন শহরে রুশ রকেট হামলায় ছয়টি বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। পরে উদ্ধারকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্তদের সন্ধান করেন।
অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনী ইউক্রেনের পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলের ইউক্রাইস্ক শহরটি দখল করেছে। উল্লেখ্য, চলমান যুদ্ধের পূর্বে শহরটিতে ১০,০০০ এর বেশি মানুষ বাস করত।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতি
এদিকে পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। সাক্ষাতে বাইডেন জেলেনস্কিকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাশে থাকবে এবং কিয়েভ এই যুদ্ধে বিজয়ী হবে। এসময় বাইডেন আগামী মাসে জার্মানিতে ইউক্রেনের ৫০টি মিত্র দেশের উচ্চপর্যায়ের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ঘোষনা করেন।
অপরদিকে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসও জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ইউক্রেনের প্রতি তার অবিচল সমর্থনের কথা জানান। সাক্ষাতকালে কমলা তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের নীতি রাশিয়ার প্রতি আত্মসমর্পণমূলক। কারণ ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা। অবশ্য শুক্রবার ট্রাম্পও জেলেনস্কির সঙ্গে নিউ ইয়র্কে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাকে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ইউক্রেনের জন্য একটি সামগ্রিক ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
রাশিয়ার পরমানু ও নিরাপত্তা নীতি
এদিকে গতকাল ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, রাশিয়ার পারমাণবিক নীতি সম্প্রসারণের পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি একটি সংকেত যে, রাশিয়ার ওপর আক্রমণের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হবে।
অপরদিকে রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার আদেশে রেলওয়ে ও যোগাযোগ সরঞ্জামে আগুন লাগানোর অভিযোগে তিন কিশোরসহ ছয়জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে।
শিশু বিনিময়
এদিকে কাতারের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন এবং রাশিয়া ১৩টি শিশুর বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। কাতারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াটি সফল হলে নয়টি শিশু-কিশোর এবং ১৯ বছর বয়সী একজনকে ইউক্রেনে তাদের পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত করা যাবে। পাশাপাশি চারটি শিশুকে রাশিয়াতে তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হবে।
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ
এদিকে পোল্যান্ডের একটি আদালত ২৩ বছর বয়সী একজন ইউক্রেনীয় নাগরিক এবং বেলারুশের একজন ৩০ বছর বয়সী নাগরিককে রাশিয়ার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দিয়েছে। তারা মূলত ১৬ জনের একটি গুপ্তচর চক্রের অংশ ছিল, যারা ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের তথ্য সংগ্রহ করত।
অস্ত্র ও সামরিক তৎপরতা
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের জন্য প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের নতুন সামরিক সহায়তা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জয়েন্ট স্ট্যান্ড অফ ওয়েপন (জেএসওডাব্লু) যা ইউক্রেনের দূর পাল্লার আক্রমণে সক্ষমতা বাড়াবে এবং এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে তাদের সহায়তা করবে। অপরদিকে লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবারগিস বলেছেন, ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্রের স্বাধীন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া উচিত এবং তিনি আশা করছেন ইউক্রেন এই নতুন অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার আরও গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম হবে।
উপসংহার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ৯৪৫তম দিনে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে কূটনৈতিক মঞ্চ পর্যন্ত ঘটেছে নানা ঘটনাপ্রবাহ । সেইসাথে বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও কৌশলগত নীতি এই সংঘাতের অগ্রগতি এবং গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সূত্র: আল জাজিরা এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম