নিউজনেস্ট

হাসান নাসরুল্লাহ: রহস্যময় জীবন ও নেতৃত্ব

হাসান নাসরুল্লাহ: রহস্যময় জীবন ও নেতৃত্ব
প্রয়াত হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

হাসান নাসরুল্লাহ। হিজবুল্লাহর দীর্ঘমেয়াদী একজন প্রধান নেতা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। ৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে তিনি শুধু লেবাননেই নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। গতকাল ইসরায়েলের এক শক্তিশালী বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন তিনি। আজ ২৮শে সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েল উভয়েই নিজস্ব বিবৃতিতে হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে।  

হাসান নাসরুল্লাহর জন্ম

১৯৬০ সালে লেবাননের বাঝুরিয়া শহরে জন্ম গ্রহণ করেন হাসান নাসরুল্লাহ।  ৯ ভাইবোনের মধ্যে পিতাপাতার প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন বৈরুতের একজন সাধারণ মুদি দোকানদার। লেবাননের বৈরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন হাসান নাসরুল্লাহ। পরবর্তীতে লেবাননের রাজধানীর সন্নুলফিল এলাকায় মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন তিনি।

গৃহযুদ্ধ এবং হাসান নাসরুল্লাহ

১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে নাসরুল্লাহ তার পরিবারসহ বৈরুত থেকে দক্ষিণ লেবাননের বাঝুরিয়া শহরে ফিরে যান। ১৯৭৭ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ইরাকের নাজাফ শহরে যান। সেখানে ধর্মীয় পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে ইরাক সরকার শত শত লেবানিজ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করলে তিনি লেবাননে ফিরে এসে বালবেক এলাকায় ধর্মীয় শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন।

হিজবুল্লায় যোগদান ও রাজনৈতিক উত্থান

নাসরুল্লাহ প্রথমে মুসা আস-সদরের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন হারাকাতুল আমালে  যোগ দেন এবং দ্রুত পূর্ব লেবাননের বাকা উপত্যকার একটি গ্রুপের নেতা হয়ে উঠেন। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণের পর তিনি আমাল ছেড়ে হিজবুল্লাহতে যোগ দেন।

হিজবুল্লাহ মূলত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮০ এর দশকের শেষ দিকে, নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর সামরিক র‌্যাঙ্কে দ্রুত উন্নতি করে একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মাঝখানে আবার তিনি ধর্মীয় শিক্ষার জন্য তিনি ইরানের কোম শহরে যান। এরপর ১৯৮৯ সালে লেবাননে ফিরে এসে নাসরুল্লাহ গৃহযুদ্ধের শেষ ধাপের লড়াইয়ে অংশ নেন। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর তৎকালীন প্রধান আব্বাস মুসাভির মৃত্যুর পর নাসরুল্লাহ সংগঠনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে হিজবুল্লাহর উত্থান

নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠনে পরিণত হয়। ইরানের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় সংগঠনটি আধুনিক অস্ত্রসহ  প্রায় এক লক্ষ সদস্য নিয়ে একটি সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী গঠন করে।

২০০০ সালে নাসরুল্লাহর কৌশলগত নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি বাহিনীকে দক্ষিণ লেবানন থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যা হিজবুল্লাহকে আরব বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ দুই ইসরায়েলি সেনাকে বন্দী করার পর ৩৪ দিনের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ইসরায়েলি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করায় আঞ্চলিক বীর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন  নাসরুল্লাহ। যদিও ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দেওয়ায় নাসরুল্লাহর জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পায়, কিন্তু তখনও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবেই থেকে যান।

জনজীবনে সীমিত উপস্থিতি ও নিরাপত্তা সতর্কতা

নাসরুল্লাহ তার জনজীবনে অত্যন্ত সীমিত উপস্থিতি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতেন। তিনি সবসময় ফোন ব্যবহার করতেন সাবধানতার সাথে এবং পারিবারিক ও দলের ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া বাইরের সামাজিক যোগাযোগ থেকে দূরে থাকতেন। ইসরায়েলি বাহিনীর টার্গেটে থাকার কারণে, তার সাক্ষাৎকারের সময় সাংবাদিকদেরও চোখ বাঁধা অবস্থায় অজানা স্থানে নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া হতো। নাসরুল্লাহর নিরাপত্তার জন্য তার নিরাপত্তা কর্মীরা প্রতিটি সরঞ্জাম, এমনকি কলম পর্যন্ত পরীক্ষা করতেন। অবশ্য এই কঠোর সতর্কতা তার নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ছিল।

ইসরায়েলের টার্গেট ও সাম্প্রতিক হামলা

হাসান নাসরুল্লাহ সবসময়ই ইসরায়েলের শীর্ষ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন।  ১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর প্রধান হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন নাসরুল্লাহ। ইসরায়েল কয়েকবার তাকে  হত্যার চেষ্টা চালায়।

  • ১৯৯২ সাল

তৎকালীন হিজবুল্লাহ প্রধান আব্বাস মৌসাবকে হত্যার পর হিজবুল্লাহর প্রধান হিসেবে নাসরুল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পরই ইসরায়েল তাকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালায়। কিন্তু ইসরায়েল এতে ব্যর্থ হয়।

  • ১৯৯৫ সাল

১৯৯৫ সালে ইসরায়েলের মিত্র আমেরিকা নাসরুল্লাহকে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং তার সম্পর্কে তথ্যের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।

  • ১৯৯৭ সাল

এই বছর আবারও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হিজবুল্লাহ প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। যদিও এটি সফল হয়নি, কিন্তু এটি তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

  • ২০০৬ সাল

তামুজ যুদ্ধের সময় নাসরুল্লাহ ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হন। কিন্তু সেখান থেকেও তিনি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান। যা তার নেতৃত্বের শক্তি বাড়ায় এবং সংগঠনের সমর্থক এবং সদস্যদের মধ্যে সাহস জোগায়।

  • ২০০৮ সাল

২০০৮ সালে ইসরায়েল একটি গোপন সুড়ঙ্গে আক্রমণ করার দাবি করে, যেখানে নাসরুল্লাহ থাকার সম্ভাবনা ছিল। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

  • ২০২৪ সাল

সর্বশেষ ২৮সে সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ, গাজায় চলমান যুদ্ধের ৩৫৮তম দিনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ঘোষণা করে, তারা বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে, যেখানে নাসরুল্লাহসহ হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হয়।

উপসংহার

হাসান নাসরুল্লাহ কেবল লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে সফলভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও তিনি নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছেন।

যদিও সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কারণে তার জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে, তবুও একজন অপ্রতিরোধ্য আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই তিনি এতদিন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তার রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল শুধু হিজবুল্লাহ নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতেও গভীর ছাপ ফেলেছে, ভবিষ্যতে যার আরও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দেখা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত