জর্ডানের কাছে আম্মানে একটি বিবাহ-প্রস্তাবের অনুষ্ঠান। অতিথিরা পরষ্পর পরিচিত হচ্ছেন, কথাবার্তা বলছেন। হঠাৎ অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজন অতিথি ঘোষণা দিলেন, কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দার নতুন বক্তব্য প্রচার হচ্ছে। মুহূর্তেই বদলে গেল অনুষ্ঠানের দৃশ্যপট।
সবাই বসে গেল আবু উবাইদার বক্তব্য শুনতে। উপস্থিত সকলে আগেই উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ, ৩৩ দিন ধরে আবু উবায়দার কোনো বক্তব্য আসেনি। আশঙ্কা অনেকের, হয়তো তিনি শহিদ হয়েছেন। ফলে মানুষের মাঝে এক মাস পর আবু উবাইদার কণ্ঠস্বর শোনার উত্তেজনা ছিল স্পষ্ট।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর আবু উবাইদা আরবের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আবু উবাইদা শুধুমাত্র একজন মুখপাত্রই নন, বরং আরব বিশ্বে মানুষের কাছে তিনি প্রতিরোধের প্রতীক। গাজার ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিটি দিন যেন তার কণ্ঠে আরব বিশ্বে নতুন করে জাগ্রত হয়।
ঐতিহাসিক প্রতিরোধের সাথে আবু উবায়দার সম্পর্ক
প্রতিরোধের অমরত্বের ইতিহাস নতুন নয়। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক ১৯৫৭ সালের ৭ই অক্টোবর আলী লাপয়েন্টে শহিদ হয়েছিলেন। কিন্তু তার সাহসিকতা আজও আলজেরিয়ার মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার প্রতীক। আবু উবায়দা যেন সেই সাহসিকতার ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছেন। যেমনটি তার প্রতিটি দৃঢ় বক্তব্যে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তার সাহসিকতা যেন আরব বিশ্বকে আবারও বলছে, প্রতিরোধ এখনও বেঁচে আছে!
আবু উবায়দা এবং আরব বিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক
গত বছরের অক্টোবর থেকে আরব বিশ্বে আবু উবায়দার প্রতীকী ভূমিকা বিশাল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশে তার নাম প্রতিরোধের একটি চরিত্র হিসেবে উচ্চারিত হয়। লেবাননের বৈরুতের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে তার ছবি। মসজিদগুলোতে মাইক ব্যবহার করে তার বক্তব্য প্রচার করা হয়। জর্ডানে জিমে অনুশীলনরত যুবকেরা তার বক্তব্য শোনার জন্য অনুশীলন থামায়। এমনকি বিভিন্ন দেশের বিয়ের অনুষ্ঠানেও তার কথা শোনার জন্য বিরতি দেওয়া হয়। মিসরে তার নামে গান লেখা হয়। আরবের অন্যান্য শহরগুলোতে যুবকেরা তার বক্তব্য শোনার জন্য নিজেদের কাজ থামিয়ে দেয়। আলজেরিয়ার শিশুরা নাটক ও খেলায় তার চরিত্রে অভিনয় করে প্রতিযোগিতা করে। তুরস্কে আবু উবায়দাকে অনুকরণ করা একটি প্রিয় খেলা হয়ে উঠেছে। এমনকি তার ছবি ক্যাফেগুলোতে ঝুলে থাকে। আরব দেশগুলোর বিভিন্ন শিশুদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায় তারা তার বক্তব্য অনুসরণ করছে বা তার মতো করে সাজছে! এমনকি অসুস্থ বৃদ্ধরাও তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য শুনছে।
আবু উবাইদা এবং পশ্চিমা মিডিয়ার নীরবতা
তবে পশ্চিমা মিডিয়া সাধারণত আবু উবায়দার মতো ব্যক্তিত্বকে ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা করে থাকে। কারণ, পশ্চিমা সমাজ একজন মুসলিম প্রতিরোধকারী সম্পর্কে কথা বলতে চায় না। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক খালেদ যা বেইডুন বলেন, মুসলিমরা ন্যায়সংগত কারণে লড়াই করলেও তাদের প্রতিরোধকে পশ্চিমা সমাজে ভীতিকর বা সন্দেহজনক চোখে দেখা হয়। আর ঠিক এই বৈষম্যই আবু উবায়দাকে পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দৃঢ় অবস্থান দান করেছে।
প্রতিরোধের নায়ক আবু উবায়দা
আবু উবায়দার বক্তব্য আরব জনতাকে আন্দোলিত করে। কারণ, তার কথা শুধু সামরিক ভাষার নয়, বরং আরবের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক আবেগের প্রতিফলনও করে। তিনি কেবলমাত্র সামরিক অভিযানের বর্ণনা দেন না, বরং তার বক্তব্যে থাকে আরব জাতীয়তাবাদ, সম্মান এবং প্রতিরোধের দৃঢ়তা। তার কণ্ঠস্বর একটি ঐক্যবদ্ধ আরব জাতির আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। তার প্রতিটি শব্দ এমন এক আবেগময় শক্তি, যা অন্যের মনে প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা যোগায়।
প্রতিরোধের মুখপাত্র
২০০৬ সালের আল ওয়াহম আল মুতাবাদ্দিদ অভিযান এবং অক্টোবরে আরব জনতার মনোযোগ কাড়ার পর আবু উবায়দা আরব বিশ্বের এক নতুন প্রতিরোধ প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছেন। তার বক্তব্য কেবল একজন সামরিক নেতার ভাষণ নয়, বরং আরব বিশ্বে নতুন করে প্রতিরোধের বার্তা পৌঁছে দেয়। তার প্রতিটি কথায় আরব জাতির ঐক্য, মর্যাদা এবং প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন ঘটে।
মোটকথা, আবু উবায়দা আজ আরব বিশ্বের হৃদয়ে এক শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রতীক। তার কণ্ঠস্বর প্রতিরোধের বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। যা শুধুমাত্র প্রতিরোধের জন্য নয়, বরং আরব জাতির এক সাহসী এবং অবিচল প্রতিরোধের মনোভাব প্রকাশ করে।
সূত্র: আল জাজিরা