যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে গাজা। দখলদার বাহিনী নির্মমভাবে বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করায় গাজাবাসী এক অভূতপূর্ব মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। গাজার সরকারি তথ্য অফিসের হিসেব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে গাজার সরাসরি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
তুফানুল আকসা যুদ্ধের পরবর্তী প্রভাব
গেল এক বছরে গাজার অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে দখলদার বাহিনী। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, কৃষি খামার এবং মাছের বাজারগুলোকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে তারা। এতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও বিশাল পরিমাণে মানবিক ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে প্রায় ৮৩ হাজার টন বোমা ফেলেছে গাজার সাধারণ মানুষের উপর। এতে গাজায় ৪২ হাজার মানুষ শহিদ হওয়ার পাশাপাশি ৯৭ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। হতাহতদের অধিকাংশই আবার শিশু ও নারী।
কর্মসংস্থান, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের চিত্র
এদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনসিটিএডি) প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জানুয়ারি মাসে এই যুদ্ধে গাজার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জুন মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বেকারত্বের হার ৪৫% থেকে বেড়ে ৮০% এ পৌঁছেছে। ইউরো মেডিটেরেনিয়ান মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় যেখানে আগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫০%, সেখানে এক বছর যুদ্ধের পর দারিদ্র্যের হার ১০০% এ পৌঁছেছে।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার সংকট
ইউএনসিটিএডির তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৮০%-৯৬% কৃষি সম্পদ; যেমন সেচ ব্যবস্থা, পশুখামার, বাগান, যন্ত্রপাতি এবং সংরক্ষণাগার সবকিছু ইসরায়েলের আগ্রসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেছে। সেই সাথে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তো আছেই।
গাজার পানির সংকট
যুদ্ধের ফলে গাজার পানির অবকাঠামোও ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, গাজার প্রায় ৬৭% পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী, পানির অবকাঠামো ও বিদ্যুতের অবকাঠামো ধ্বংস এবং যন্ত্রাংশ প্রবেশে বাধা দেয়ার কারণে পানি উৎপাদন ৮৪% কমে গেছে। এতে প্রায় ৮৮% কূপ ও ১০০% পানি বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে।
খাদ্য সংকট: ক্ষুধার হাতছানি
পানির সংকটের পাশাপাশি খাদ্য সংকটও তীব্র হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে গাজা এবং উত্তর অঞ্চলে মন্দা শুরু হওয়ায় কঠোর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজার প্রায় ৫০,০০০ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। যুদ্ধের আগে গাজায় প্রতিদিন প্রায় ৬০০ ট্রাক প্রবেশ করতে পারলেও বর্তমানে গাজায় মাত্র ৫০ ট্রাক খাদ্য সামগ্রী প্রবেশ করতে পারছে।
সংকটের স্থায়ী প্রভাব
গাজার অধিকাংশ অবকাঠামোও ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। যার মধ্যে স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সরকারি দপ্তরও রয়েছে। গাজার প্রায় ৪,০০,০০০ আবাসিক ইউনিটের মধ্যে ১,৫০,০০০ ইউনিট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে এবং ২,০০,০০০ ইউনিট আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১২৫টি স্কুল -বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণরূপে এবং ৩৩৭টি আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটময়। দখলদার বাহিনীর আক্রমণ এবং অবরোধের ফলে গাজাবাসী এক নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে। পানির অভাব, খাদ্য সংকট, কর্মসংস্থানের অভাব এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিপর্যয় গাজার মানুষের জীবনকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা ও আনাদোলু